Skip to main content

 

দেখুন আমরা মধ্যবিত্তেরা, সাধারণ মানুষেরা অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ন্যায়-নীতি, সততা ইত্যাদির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে নিই শুধু নিরাপদে থাকব বলে। শান্তিতে থাকব বলে। আমাদের কাছে নিরাপত্তা আর শান্তি একই কথা। আমাদের এই নিয়ে অনেকে অনেক বিদ্রুপ করে ছাপোষা, ভীতু, সুবিধাবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি বলে। কিন্তু ওই যে ‘'কাঞ্চনজঙ্ঘা’’ সিনেমার ওই ডায়লগটার মত আমাদের লাইফে সিকিউরিটিটাই সব চাইতে বড় কথা এবং শেষ কথা। “আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে” - এই দুধভাতটা আমাদের পুষ্টিবিজ্ঞানের দ্রব্য ততটা না, যতটা আমাদের শান্তি ওরফে নিরাপত্তার পরিচায়ক।

আমরা ভীতু, ভীষণ ভীতু। আর আমরা রাস্তায় নামছি কেন জানেন ওই একটাই কারণে, আমরা ভীতু বলে। আমাদের নিরাপত্তায় থ্রেট এসেছে বলে। আমাদের ঘরে ঘরে লোকনাথবাবার আহ্বান কেন জানেন? আমরা ভীতু বলে। উনি আমাদের রণেবনে ইত্যাদিতে রক্ষা করবেন কথা দেন বলে। আমরা গ্রামের লোকেরা মা মনসা, দক্ষিণারায়, শীতলা প্রমুখ দেবদেবীদের পুজো কেন করি জানেন? হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা ভীতু বলে। আমরা বাঙালিরা ওই যে মাতৃমুখী….দুর্গা, কালী ইত্যাদি পুজো করি, সেও আমরা ভীতু বলে। মায়ের দেওয়া নিরাপত্তার মধ্যে কোনো শর্ত নেই, বাবার আছে। তাই আমরা মাতৃঘেঁষা। এতে আমাদের কোনো লজ্জা নেই। মাইরি বলছি, হ্যাঁ আমাদের কোনো লজ্জা নেই। আমরা গুচ্ছের গুচ্ছের ব্লাড টেস্ট করাই, প্রেসার মাপাই, ইসিজি করাই, ইউএসজি করাই….সব আমরা ভীতু বলে। এই যে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ পারতপক্ষে খ্যাঁটে টান না পড়লে সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে নামী অনামী নার্সিংহোমে যাই, সেও আমার ভীতু বলে। (লেখক যদিও সে গোত্রের না। তার ভরসা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জওহরলাল হাসপাতাল)। আসলে আমাদের মধ্যে একটা গুজব আছে সরকারি হাস্পাতালে গেলে নাকি চিকিৎসা পাওয়া যায় না, অল্প সময় নিয়ে দেখে ডাক্তারেরা, অনেক লাইন ইত্যাদি।

এই দেখুন না, আমার বাবা তো রেলের কর্মচারী ছিলেন। তো একবার যখন বাবা ভীষণ অসুস্থ হলেন ২০১৭ সালে, আমি বিআরসিং রেলের হাসপাতালে দিলাম। সবাই বললে বাবাকে নাকি মারার ধান্দা করছি। নইলে রিট্যায়ারড মানুষকে কেউ সরকারি জায়গায় দেয়? ওরা তো পেনসান দিতে হবে না বলে আগেই মেরে দেবে। কী আশ্চর্য না? এই গুজবে জানেন বহু রেলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী রেলের হাস্পাতালেই ভর্তি হন না। সিরিয়াসলি বলছি, ঠাট্টা না। তো বাবা কোমায় চলে গেলেন। লোকে বলল, আর কেন এবার শ্রাদ্ধশান্তির আয়োজন করে ফেল, বাবাকে তো মারার কল করেই ফেলেছ। কিন্তু বাবা সেই হাস্পাতালের ডাক্তারদের চিকিৎসায় আর বাইরে থেকে আমার এক অত্যন্ত সুহৃদ সরকারি চিকিৎসকের চেষ্টায় ফিরে তো এলেন। তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আজ অবধি বাবাকে দেখলেই তাঁদের মুখ মনে পড়ে। ধন্যবাদ জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই।

তো যেটা বলছিলাম, সেই আমরাই আবার বিপাকে পড়লে এসএসকেএম এ একটা বেড পাওয়ার জন্য নেতামন্ত্রী কী না ধরি। এ সব করি দাদা আমরা একটু সুরক্ষিত থাকব বলে। আমাদের মানইজ্জত, ডিগনিটি ইত্যাদি নিয়েও ভাবি না একটু নিরাপদে থাকব বলে।

দাদা, দিদি, আজকে আমাদের সেই নিরাপত্তার বোধটা ভীষণ নড়বড়ে হয়ে গেছে গো। তাই আমরা রাস্তায়। তাই আমরা অস্থির। তাই আমরা বেসামাল। দেখুন আমরা এমনিতে রাজনীতিটীতি নিয়ে সিরিয়াসলি মাথা ঘামাই না। উচ্চৈস্বরে আলোচনা করি, তর্ক করি ওসব আমাদের বাহ্যিক ব্যাপারস্যাপার। আসলে আমরা একটু সুরক্ষা চাই।

আমি বলতে শুধু এই আমি না, আমার ভালোবাসার, আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমি একটু নিরাপদে থাকতে চাই, তার জন্য সব কিছু কম্প্রোমাইজ করতে রাজী আমরা। কিন্তু ওইখানে হাত দিলে আমাদের থেকে ভয়ংকর কিছু নেই জানেন তো! এটা হুমকি না, এটা সাবধান বাণী। আত্মপরিচয়জ্ঞাপনও বলতে পারেন।

দেখুন, আমরা এখন ভীষণ নড়বড়ে জায়গায়। আমরা বুঝতে পারছি কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে, কিন্তু কী যে হচ্ছে বুঝছি না। হোয়াটসঅ্যাপে, সোশ্যালমিডিয়ায় নানা ক্লিপিংস ঘুরছে। আমাদের আরো অস্থির করছে। ওই যে বললাম, আমাদের ল্যাজে পা পড়েছে। আমরা আর ঘুমাতে পারছি না। সব বেকার লাগছে। নিরাপদ ফিল করছি না তো আর। ফলে সব হজম করে যাওয়া অপমান, বঞ্চনা ইত্যাদি বদহজম হয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ঠেকাবেন কী করে আমাদের?

একটা উদাহরণ দিই। ধরুন আমার এক আত্মীয়ের অপারেশন চলছে। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ একজন এসে বলে গেল, ওহে যারা অপারেশন করছে তারা কিন্তু কেউ চিকিৎসক না। আমরা ঘাবড়ালাম। আরেকজন এসে বলে গেল, ওহে এইমাত্র দেখলাম কিডনিটা বার করে নিল। আমরা আরো ঘাবড়ালাম, এবং বিচলিত হলাম। তারপর একজন এসে বলল, এই দেখলাম একজন দুটো চোখ উপড়ে নিল….ব্যস….আর আমরা স্থির থাকতে পারলাম না। এদিকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে বাধা, ওদিকে আসল কথা কিছুই জানা যাচ্ছে না। এবার?

এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। দেখুন আমাদের এই ভীষণ সংকটে আমাদের ক্ষেপিয়ে দিয়ে অনেকে অনেকরকমের কার্যসিদ্ধিতে মাতবে এ স্বাভাবিক। রাজনীতিতেও আমাদেরকেই ঘুঁটি করবে এও আমরা জানি। করে নিন যার যা প্রাণে চায়, পরে আমরা সব সামলে নেব, যেমন আগেও নিয়েছি। কিন্তু দয়া করে আমাদের নিরাপত্তারবোধকে চ্যালেঞ্জে ফেলবেন না হাতজোড় করে বলছি। আমরা জানি বিচার রাস্তায় হয় না, আমার সেন্টিমেন্টের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, সব জানি। সে অবশেষে কঠোর নির্মমভাবে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নির্ভর সেও আমরা জানি। কিন্তু জানা আর মেনে নেওয়া এক না। আমরা মেনে নিতেই পারছি না যে আমাদের নিরাপত্তাবোধের সঙ্গে আপনারা ছিনিমিনি খেলছেন।

দেখুন আমরা জানি আমাদের বাংলা নিউজ চ্যানেলগুলোতে যাত্রাপালার মত করে নিউজ পড়ে, তাদের অ্যাপিলটা আমার যুক্তির কাছে ততটা না, যতটা আমার আবেগের কাছে। ওরা জানে আমাকে নিরাপত্তাহীন বোধ করাতে পারলে আমি ওদের টিআরপি আরো বাড়িয়ে দেব। আমি প্যানিক করলেই ওরা সফল। সেটা ওরা জানে। সেটা সোশ্যালমিডিয়াতেও অনেকেই জানে যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষকে রাগিয়ে দেওয়া যায় তাড়াতাড়ি, হিংসিয়ে দেওয়া যায় তাড়াতাড়ি। ওরা সব জানে। আর তাই আমাদের ব্যবহার করে। আমরা জানি সব। কিন্তু ওই যে বললাম, পরে সব আমরা সামলে নেব, আমাদের নিরাপত্তাবোধটা ফিরিয়ে দিন প্লিজ।

কী ভাবে?

আসল দোষীকে খুঁজে বার করে। তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে। আমাদের নিরাপত্তার বেড়াটাকে আবার বেঁধে দিন প্লিজ। নইলে কিন্তু আমরা যা কিছু হতে পারি, সুনামি থেকে কালবৈশাখী সব। শুধুমাত্র আমাদের নিরাপত্তার জন্য, আমার ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার জন্য আমি সব করতে পারি। বুঝেছেন তো। সময় নিন। কিন্তু ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না প্লিজ। ওদের সামনে আনুন। শাস্তি দিন। আমরা আবার শান্ত হয়ে খালবিল হয়ে যাব দেখবেন। কিন্তু প্লিজ, আমাদের ল্যাজে পড়া পা'কে তুলুন। বিচারকে স্বচ্ছ, সঙ্গত করুন। ব্যস।