Skip to main content

মানুষও তাপগ্রাহী আর তাপমোচী হয়। তাপগ্রাহী দুর্লভ। তাপমোচী সুলভ। যত কাছে যাবে তত আঁচ গায়ে লাগবে। যত দূর থেকে দেখবে তত শীতলতা থাকবে।

অনেকে বলেন, সম্পর্ক দূর থেকেই ভালো। বেশি কাছে গেলেই ঠোকাঠুকি। স্বাভাবিক। দুই তাপমোচী যদি পাশাপাশি আসে, যা হওয়ার তাই হবে।

মানুষ যে তাপমোচী প্রাণী সেটা লকডাউনে হাড়েহাড়ে সব বুঝেছিল। সবাই এত কাছাকাছি চলে এসেছিল যে সম্পর্কের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। রাতদিন ঠোকাঠুকি। মনোবিদরা বুঝিয়েসুঝিয়ে হেদিয়ে গিয়েছিল। ওই যে একটা পশ্চিমী শব্দ আছে না - স্পেস দাও সম্পর্কে। ওর মানে কী? মানে একদম ঘাড়ের উপর দুটো বাড়ি পাশাপাশি কোরো না। এক প্লটে বাড়ি কিনেছ, ভালো কথা। কিন্তু তবু মাঝে স্পেস রাখো। যাতে জানলা খোলা যায়। জানলা দিয়ে গরম বাতাস বেরিয়ে যেতে পারে।

মন তাপমোচী। তাই মানুষ তাপমোচী। মন তাপ উৎপন্ন করে, তারপর সেই তাপ জুড়াবে বলে জল খুঁজে বেড়ায়। গুরু, ভজন, তত্ত্বকথা, গান, নাচ, মদ, ক্লাব, বন্ধু ইত্যাদি, কেউ একজন একটু আমার মনের তাপ কমিয়ে দে রে ভাই, এই বলে দৌড়ে বেড়ায়। কখনো হয় তো কমে, তবে স্বল্পক্ষণের জন্য।

দেখেন মনের স্বভাব যে তাপমোচী সে আমাদের কামারপুকুরের ঠাকুর আগেই বুঝেছিলেন। তিনি পঁইপঁই করে বলে গেলেন, ভাই রে মন কুকারের মত। একটা সেফটিভালভ লাগাও। মাঝে মাঝেই সিটি দেবে, ভয়ে কাছের লোক দূরে যাবে, ওতে ক্ষতি অত নেই, যতটা তুমি বার্স্ট করলে। তোমার ও একটা “আমি” আছে না? মানে আরকি তোমার ইন্ডিভিজুয়ালিটি। যার নামে একটা আধারকার্ড নাম্বার আছে। একটা, কি দশটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। জমির দলিল আছে। বাড়ি গাড়ির কাগজে তার নাম আছে। ক্লাবে যার নামে মেম্বারশিপের চাঁদা দেওয়া আছে। ওই আমিটাকে একটু সামলে রেখো। সেই আসল তাপমোচী। কী ভাবে হবে? তো কামারপুকুরের ঠাকুর বলছেন, ‘আমি’’ তো যাবে না, যতই তাড়াও আবার আসবে। তার চাইতে থাকুক শালা “দাস” হয়ে। ওকে সামলানো মানে, মাঝে মাঝে ওকে ভ্যাক্সিন দাও। সাধুসঙ্গ করাও। উদারতা আসুক। মনে জমা তাপ খানিক হলেও বেরোক। মা সারদা বললেন, বাবা নিজের দোষ দেখো, অন্যের দোষ দেখে বিশেষ লাভ নেই। যত খোঁজো, তত বেরোবে? তারপর? রাখবে কোথায়? অন্যের বাড়ির সেফটিট্যাঙ্ক কি তোমার জমিতে করতে দেবে? তবে অন্যের মনের হাগামোতা খুঁজে খুঁজে আমার মনে জমিয়েও বা কী করবে?

দাঁড়ান, একটা তো বিপজ্জনক কথা বলে বসেছি। সাধুসঙ্গ। তা এর মানে কী? না, সাধুসঙ্গ মানে গেরুয়াসঙ্গ না। আজকাল গেরুয়াও তাপমোচী। বলা যায় অনেক বেশি তাপমোচী অগেরুয়া থেকে। সে কথা না। তবে সাধুসঙ্গ মানে কী? যে সঙ্গে নিজেকে তুচ্ছ বলে মনে হয়। খোলা মাঠ। সমুদ্র। হিমালয়। এ সব তো আছেই। কিছু না হলে রবীন্দ্ররচনাবলীর ধুলো ঝাড়ি আমি। ধুলো না জমলেও ঝাড়ি। কথামৃতের পাতার পরে পাতা উলটে যাই। পড়ি না। চোখকে মনের সাথে বেড়াতে নিয়ে যাই। চুম্বকের পরীক্ষা লোহার সামনে। তেমন আসল সাধুর পরীক্ষা তাপিত মনের সামনে। মন যেখানে শীতল হয়, সেই আমার সাধুসঙ্গ। সে যদি দরজা দিয়ে টয়লেটে বসে গান শুনলেও হবে, তবে তাই আমার সাধুসঙ্গ। কিন্তু এই সাধুসঙ্গটা খুব দরকার।

দেখুন মানবতাকে সহজেই ভালোবাসা যায়। অনেক সহজেই হিউম্যানিস্ট হওয়া যায়। কিন্তু একজন মানুষকে ভালোবাসতে ধক চাই। ওই জন্যে যীশু বলছেন, পাশের মানুষটাকে ভালোবাসো। মানবিকতা তো হাওয়াই মিঠাই। মুখে দিলেই গলে যাবে। ওতে হবে না। একজন গোটা মানুষকে আস্ত ভালোবাসো। কঠিন কাজ। কিন্তু ওই সাধুসঙ্গ করতে করতেই সহজ হবে। হতেই হবে।

মন তাপমোচী। ভাষা তাপমোচী। অনেকে মন আর ভাষার মধ্যে একটা ইনসিলুটেড ফিল্টার লাগিয়ে কাজ চালান। মনের তাপমাত্রা যখন নিরানব্বই ছুঁই ছুঁই, ভাষাকে সেই কৌশলে হয় তো বিয়াল্লিশ, তেতাল্লিশে নামিয়ে আনা গেল। ভালো কৌশল। কিন্তু বেশিদিন কাজ করে না। উপায়? সম্পর্ক থাকুক। কিন্তু মাখামাখিটা যতটা এড়িয়ে যাওয়া যায় ততটাই স্বাস্থ্যকর। এই মাখামাখিতে জটিল একটা ওয়ারিং তৈরি হয়, একের তাপে অন্যে পুড়ে মরে। তার চাইতে আলাদা মিটার বক্স, আলাদা ইনভার্টারের ব্যবস্থা থাকা ভালো। ওতে সম্পর্ক মধুর থাকে। সেই এক স্পেসের তত্ত্ব চলে এলো। সব থাকুক, অবশেষে হাতের মুঠোয় শুধু ঘামই জমুক। মাঝে মাঝে ঘাম মুছে নিলেই হবে। হাত শুকনো হলেই বিপদ। ওকে বিষাদ বলে। থাক। অদ্দূর না। শূন্য হাতে, শূন্য মুঠোয় ঘাম জমুক। আমি সামলে নেব।