রামকৃষ্ণদেব বললেন, মন আর মুখ এক করাই হল আসল তপস্যা।
এখন কথাটার মানে হল কি? আমার এক রসিক বন্ধু এক পাগলকে রাস্তায় অনর্গল কথা বলতে দেখে বলেছিলেন, এই এক মানুষ দেখলাম যার মন আর মুখ এক হয়েছে।
স্বামীজি কি মন আর মুখ এক করার কথা বললেন? বরং সংসারের কপটতার দিকটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, "হও জড়প্রায়, অতি নীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল---, / সত্যহীন, স্বার্থপরায়ণ, তবে পাবে এ সংসারে স্থান।"
যারা ইদানীং কয়েকটা বিদেশী সাহিত্য পড়ে আমাদের বোঝাতে চান যে সংসারের অন্ধকার দিকটাকে নিয়ে লেখা যেন তারাই প্রথম লিখছেন, তাদেরকে স্বামীজির 'সখার প্রতি' কবিতাটার প্রথম কয়েক স্তবক পড়ে দেখার অনুরোধ জানাই। যেখানে শুরুতেই বলছেন, "পিতা পুত্রে নাহি দেয় স্থান, / হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান?"... তবে সে আলোচনার জায়গা এটা না। কথা হচ্ছিল মন আর মুখ এক করা নিয়ে। তা মন আর মুখ এক হলে এ সংসারে যে ঠাঁই পাওয়া মুশকিল সে তো বড় সত্য কথাই। 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা' গল্পটা মনে নেই? আচ্ছা সে না হয় গল্প হল, ভাবুন রামকৃষ্ণদেবের বাবার কথা। একটা মিথ্যা সাক্ষ্য দেবেন না বলে ভিটেমাটি ছেড়ে গাছতলায় সপরিবার নিয়ে দাঁড়াতে হল! একবার ভেবে দেখুন তিনি তো আর কেষ্টবিষ্টু কেউ নন, আমাদের মত সাধারণবোধের মানুষ। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তা তাঁর পুত্র যখন বলেন "সত্যের আঁট থাকলে ভগবানলাভ হয়", তখন মনে হয় তিনি যেন রাসমণির আঙিনায় বসা রামকৃষ্ণ নন, তিনি যেন শুধুই কামারপুকুরের গদাধর, তাঁর স্মৃতিতে যেন গাছতলায় সপরিবারে দাঁড়ানো নিজের বাবা, ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের মুখটাই ভেসে ওঠে। অবশ্যই তিনি তখনও জন্মাননি, কিন্তু সে গল্প নিশ্চয় হাজার একবার শুনেছেন! একজন মানুষের মেরুদণ্ডের জোর কতটা হলে এ সম্ভব তাই ভাবি! ঈশ্বর মানে যদি শুধু যাদুকর হন তবে সেখানে নীতির কথা আসে না, কিন্তু ঈশ্বরের বোধ যদি সত্যানুরাগের ব্রত নিয়ে আসে তখন তার অর্থ বদলে যায় বইকি।
তবে স্বামীজি যে বললেন তার অর্থ কি? আরেকটা গল্প। স্বামীজি এক ভাষণে বলছেন, একজন এসে তাকে জিজ্ঞাসা করছেন, মুক্তি কিসে হবে? স্বামীজি তাকে বলছেন, তুমি দিনে কয়েকটা করে মিথ্যা কথা বলা অভ্যাস করো। বলে স্বামীজি বলছেন, আসলে লোকটা এত জড়, এত তামসিক যে মিথ্যা কথা বলার জোরটুকু পর্যন্ত নেই। শ্রীঅরবিন্দ বলতেন, বাইরের জগতে যদি লড়াইয়ে জয়ী হতে না পারো তবে অন্তরের জগতে লড়াইয়ে টিকবে কি করে? সেখানে তো বিরোধীশক্তি মূর্ত, এখানে তো সব অদৃশ্য! স্বামীজি গল্পটা বলেই বলছেন, অবশ্যই আমি আপনাদের মিথ্যাকথা বলতে প্ররোচিত করছি না, কিন্তু আমাদের স্বভাবের জড়ত্বের কথা বলছি। "গরুকে কখনও মিথ্যা কথা বলিতে শুনি নাই, কিন্তু উহা চিরকাল গরুই থাকে, কখনই মানুষ হয় না।"
যে কবিতাটার কথা দিয়ে শুরু করলাম স্বামীজির সেই কবিতাটার শেষই হচ্ছে সেই বিখ্যাত লাইন দিয়ে, "জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর"। এই কবিতাটাতেই বলছেন, "'প্রেম', 'প্রেম' - এই মাত্র ধন"। জপ-তপ, যাগযজ্ঞ, তীর্থ উপবাস সব ছাড়তে বলছেন, কিসের জোরে? ভালোবাসা। কিরকম ভালোবাসা? "দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম-অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।" - এমন সর্বগ্রাসী ভালোবাসায়। আরো বলছেন, "ভিক্ষুকের কবে বলো সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল? / দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল"..।
তবে এত কথার সঙ্গে মন আর মুখ এক করার কি সম্পর্ক? আছে। আমাদের প্রাণ আছে, মন আছে, বুদ্ধি আছে। প্রাণে নানা ভাব ওঠে, যাকে বলে instinct, জন্মগত স্বভাব - সে সবই কি মার্জিত? না তো। রামকৃষ্ণদেব এক প্রার্থনা শেখাচ্ছেন, "মা আমার পশুভাব দূর করো।" এ পশুভাব মানে কি? ওই অমার্জিত প্রাণিক ঢাল। আলগা দিলেই গড়িয়ে পড়ে। মন মুখ এক করা মানে কি সেই অমার্জিত স্বভাবের গতিকে 'হ্যাঁ' বলা? না তো।
এরপরে আসে মানুষের বিচার করার ক্ষমতা। ভালোমন্দ বিচার করার ভাব। সেই ভাবের সঙ্গে যেন আমার আচরণের বিরোধ না ঘটে। রবীন্দ্রনাথ তার বিখ্যাত প্রবন্ধ 'বিদ্যাসাগর'-এ বলছেন, "আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না;" আমাদের স্বভাবের এই অস্পষ্টতা, চাতুরীর দিকটাকে রবীন্দ্রনাথ ঘৃণা করতেন। তাই তিনি বলেই ফেলেছিলেন, "...মাঝে মাঝে বিধাতার নিয়মের এরূপ আশ্চর্য ব্যতিক্রম হয় কেন, বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন।"
অবশ্যই আশ্চর্যের। বার্ট্রাণ্ড রাসেল তার বিখ্যাত বই 'Conquest of Happiness' -এ বলছেন, সুখে থাকার মূলসূত্র হল, harmony, সংহতি। সেই কথাই তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষটাও বলছেন, এই মন আর মুখ এক করাই হল তপস্যা। বললাম আর হয়ে গেল তা তো নয়।
আজকে মানুষের যতগুলো সমস্যা তার মধ্যে এই সমস্যাটা সর্বাধিক। আমরা আমাদের চারপাশের উপর আস্থা হারাচ্ছি। আমরা জানি ভাষা মনের ভাব প্রকাশের না, আড়ালের উপায়। এত অনাস্থা, এত অবিশ্বাস, এত রাতদিন স্ক্যানার নিয়ে ঘোরার চাপ কি কম? এইভাবে দিন কাটাতে কাটাতে এমন হয়েছে যে নিজে যা বলছি তাও বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। কারণ জানি যা অন্যকে বলছি তা আমার উদ্দেশ্য আর অনুভবের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। অবশেষে মনে হয় যা নিজেকে বলছি সেও কি তাই? নিজেকে নিয়ে শুরু হয় সংশয়।
অগত্যা রামকৃষ্ণদেবের এই ছোট্টো কথাটি শুধু যে নেংটিপরা গুহাবাসীর জন্য বলে তো মনে হয় না। সামাজিক জীবনটাও কি দুর্বিষহ হচ্ছে দিন দিন। সেই এক সাধক কবি গাইছেন না, আমার জিভের সঙ্গে মনের দেখা হয় কখন? না শুধু খাওয়ার বেলা। তবে এ রোগ খুব প্রাচীন। নইলে উপনিষদের শান্তিপাঠে কেন বলবে, আমার বাক্যে মন প্রতিষ্ঠিত হোক? আর কবিই বা কেন লিখবেন, "বাক্য যেথা হৃদয়ের উৎসমুখ হতে"?