Skip to main content

 

 

 

 

 

রামকৃষ্ণদেবের মিশন কি ছিল? তিনি কি সত্যিই সর্বধর্মসমন্বয় বেশ পরিকল্পনা করে করেছিলেন? সে সব আলোচনা থাক।

 

      আমাদের আজকের জীবনে কি সেদিনের সংশয় আছে? অবশ্যম্ভাবীভাবেই নেই। সেদিন ক্রিশ্চান মিশনারী, ব্রাহ্মধর্ম ইত্যাদির সংঘাতে ঈশ্বরের সাকার নিরাকার নিয়ে দোলাচাল আজকের দিনে আছে? মূর্তিপুজো ঠিক কি ঠিক নয়, এইসব নিয়ে ভাবনা আজকের মানুষের কই? দরকার নেই। সে তো ভালো কথা।

      আমরা জীবনটাকে যদি অন্যভাবে একটু দেখতে চেষ্টা করি। যখন তিনি অবতার নন। কে তাঁর সম্বন্ধে কি বলেছেন, সে কথাও থাক। আমাদের নিত্যজীবনে যে রামকৃষ্ণ এসে দাঁড়ান, তিনি কে হতে পারেন?

      একজন মানুষ যিনি সম্পূর্ণভাবে নিজের খুশীতে মগ্ন। সে খুশীর স্রোত অহরহ তাঁর অন্তঃস্থল থেকে নিঃসৃত হচ্ছে। তিনি নিজে স্নাত হচ্ছেন, আশপাশকে স্নান করিয়ে দিচ্ছেন। কি সেই খুশীর উৎস? অবশ্যই ঈশ্বর। যিনি তাঁর মা। যিনি তাঁর সর্বস্ব। যিনি জগত। যিনি জগত ছাপিয়ে সব কিছু। রামকৃষ্ণ সেই জগত নিয়ে, জগত ছাপিয়ে সবসময় অস্তিত্বের মধ্যে ডুবে। যে অস্তিত্ব অনুভবের প্রকাশ – আনন্দ। উপনিষদ যে আনন্দের কথা বলেন – এ সেই আনন্দ। কোনো কিছু পেয়ে নয়, কোনো কিছু হারিয়ে নয়। আনন্দ সাগরে আনন্দের ঢেউ। কথামৃতের পাতা উল্টে যান, প্রতিটা পাতায় শুধু এই আনন্দের কথা। শুধু আনন্দের প্রকাশ। শুধুই আনন্দের গান। আনন্দের নৃত্য। আনন্দের অশ্রু। আনন্দের হাসি। ভোরের আনন্দ। গভীর রাতের আনন্দ। দুপুরের আনন্দ। সকালের আনন্দ। সন্ধ্যার আনন্দ। এক আনন্দময় আত্মমগ্নতা, কিন্তু স্বার্থমগ্ন না, এমন একজন মানুষ ছোটো একটা ঘরে, মন্দিরের চাতালে, গঙ্গার ধারে বছরের পর বছর বিচরণ করে চলেছেন।

তাঁর দাবী কি?

      আনন্দ। নিজের মুখের কথা – কেউ তাঁকে গুরু, কর্তা, বাবা ইত্যাদি ডাকলে তাঁর গায়ে কাঁটা বেঁধে। জ্বালা ধরে। অসহ্য লাগে। তবে আমি কেন যাব? শুধু আনন্দের ভাগীদার হতে? গিরিশ ঘোষের সুরার নেশার আনন্দ যে আনন্দের সঙ্গে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। এক রাতে গিরিশ ঘোষ তার সব নটীদের নিয়ে এলেন। তখন অনেক রাত। যারা এল তারা সমাজে পতিতা। হতে পারে। কিন্তু তা সেই আনন্দময় পুরুষের কাছে না। সারারাত ধরে হল নাচ, গান। কেন্দ্রে ঈশ্বর। যে ঈশ্বর মানে আনন্দ। যে ঈশ্বর মানে চেতনা। চেতনা আকাশের নীলের মত। সে নীলে আনন্দের মধু। অহরহ ঝরে পড়ছে। রামকৃষ্ণের চিত্তে সে ধারা বন্যার মত আছড়ে পড়ছে। রামকৃষ্ণ পাগল হচ্ছেন। বলছেন “ঈশ্বরের ইতি করা যায় না”। এ ঈশ্বরের শরীরের আয়তন নেই। মতের সীমারেখা নেই। স্বপক্ষ-বিরোধীপক্ষ নেই। এ ঈশ্বর অনন্ত। “মানুষ কি কম গা? মানুষ অনন্তকে চিন্তা করতে পারে”, রামকৃষ্ণ বলছেন। অনন্তের বুকে ঈর্ষা জন্মায় না। অনন্তের বুকে বেদনা। যে বেদনায় রামকৃষ্ণ কাঁদেন। কাঁদান। খাঁচার ভিতরে থাকা মানুষকে খাঁচা খুলে উড়ে যাওয়ার পথ দেখান – আনন্দে। আনন্দের অশ্রুতে অসীমের দরজার আগল খুলে যায়।

      তাই রামকৃষ্ণের কানে আরেকটা শব্দ বিষের মত বাজে – পাপ। কিসের পাপ? কার পাপ? এ সামাজিক ধর্মব্যবসায়ীদের বানানো হিসাব। আনন্দের সাগরে পাপ কই? সাগরের ঢেউয়ে উত্থান পতন আছে। সেকি পাপ? না। আগল খুলে দিলাম, এসো, শুধু তোমাদের মতলবি বুদ্ধি বাইরে রেখে এসো। আমার সামনে উন্মুক্ত হও। উলঙ্গ হও। তোমার ধর্মের সংজ্ঞা, ধর্মের হিসাব-কিতাবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার কোনো আগ্রহ নেই জানার যে মানুষ মরলে কোন লোকে যায়। আমার কোনো আগ্রহ নেই জানার যে ঈশ্বরের কত ঐশ্বর্য। আমি মাধুর্য বুঝি। তুমি রাধাকৃষ্ণের ঐতিহাসিক সত্য মানো না মানো, “টানটুকু নাও”। ওই ভালোবাসায় ডুবে যাও। ওই আনন্দে মগ্ন হও। যে আনন্দ তোমায় ডুবিয়ে না দেয়, শুধু হাঁটু অবধি ভেজায়, সে আনন্দে কি লাভ? তোমার জীবনে আশ্বিনের ঝড় আসেনি এখনও, তাই এত হিসাব তোমার। গভীর আঘাতে যেমন মানুষের স্বার্থবোধ, মতলবী বুদ্ধি থাকে না, সেরকম গভীর আনন্দেও থাকে না। তুমি অন্ধকারের গভীরতায় আলোর উদ্দীপনার তুলনা আনো, বুঝবে। যার আলোর জ্ঞান আছে, তার অন্ধকারের জ্ঞানও আছে। সুখের বোধ থাকলে দুঃখের বোধও থাকবে। তুমি আমার কাছে এসো, আমি তোমায় আনন্দের সাগরে নিয়ে যাবো।

      রামকৃষ্ণ বলতেন, আমি খালি দোসর খুঁজি। কেমন? এক ভুত একটা গাছে একা থাকত। তার খুব একা একা লাগে। কেউ শনি-মঙ্গলবার গাছ থেকে পড়েছে শুনলেই ছুটে যায়, কারণ শনি-মঙ্গলবার অপঘাতে মরলে ভুত হয়। কিন্তু সে ব্যাটা আবার পাছা ঝেড়ে উঠে পড়ে। মানে মরেনি। রামকৃষ্ণ সেরকম আকুল হয়ে নিজের ভাবের মানুষ খোঁজেন। কিন্তু পেলেন কই? 'এক'কে কেউ নানায় চায় না। একঘেয়ে ভাবে ডুবে থাকতে চায়। কিন্তু তাঁর যে একঘেয়ে ভাব একদম ভালো লাগে না। কিন্তু সেরকম নানা ভাবের ভাবে নাচে-গায় এমন মানুষ কই? যে বৈষ্ণব সে শুধুই বৈষ্ণব। যে শাক্ত সে শুধুই শাক্ত। যে শৈব সে শুধুই শৈব। যে খ্রীষ্টান সে শুধুই খ্রীষ্টান। যে মুসলমান সে শুধুই মুসলমান। যে শিখ সে শুধুই শিখ।

      কিন্তু রামকৃষ্ণ তো তা নন। তিনি শুধু আনন্দ বোঝেন। আনন্দের ধারাপাতে স্নান করেন। চিনি হতে ভালোবাসি না, চিনি খেতে ভালোবাসি। সে চিনির ব্র্যাণ্ডে চোখ পড়ে না তো তাঁর। তিনি শুধু তাকিয়ে থাকেন সে মাধুর্যের দিকে। মুগ্ধ হন। মুগ্ধ হয়ে সবাইকে মুগ্ধ করতে চান। অমৃত ঢেলে দিতে চান। যে যতটুকু নেয়। যে যেভাবে নেয়। কিন্তু তাঁর মত কেউ নেই। রামকৃষ্ণ তাই একা। কিন্তু নিরানন্দ নন। মা আছেন তো। নহবতেও আছে, মন্দিরেও আছে। নহবতের যিনি তিনি বোঝেন। কিন্তু সে তো বাইরে আসতে পারে না। সামাজিক নিয়ম। দুর্বল মানুষের চলতে গেলে নিয়ম লাগে, কি ধর্মে, কি সমাজে। অল্প বুদ্ধি, অল্প অনুভব। ঠিক-বেঠিক স্থির করতে পারে না। তাই বারবার হাত ধরে নিতে হয়। রাস্তার দু'দিকে ঘের দিয়ে রাখতে হয়।

      রামকৃষ্ণের কোনো অভিযোগ নেই। কারোর প্রতিই নেই। মানুষের অনেক অভিযোগ ঈশ্বরের প্রতি। রামকৃষ্ণের নিজের দারিদ্র্য, পারিবারিক অসুবিধা, অপমান ইত্যাদি কিছু নিয়েই কোনো অভিযোগ নেই মায়ের কাছে। একবারও বলছেন না, আমি এমন শুদ্ধজীবন কাটালাম, এমন 'মা মা' করে তোকে সারাজীবন ডাকলাম, ভাবলাম, গাইলাম, নাচলাম – অথচ আমার গলায় দিলি এমন মারণ রোগ? একবারও বলছেন না। এ তো তুচ্ছ। যখন তাঁর ভাগ্নে হৃদেকে মন্দির থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ এলো, সে বার্তা ভুল করে আগে এলো রামকৃষ্ণের কাছে। তিনি যখনই শুনলেন এ মন্দির ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ এসেছে তখনই বিনা বাক্যব্যয়ে, কোনো প্রতিপ্রশ্ন ইত্যাদি না করে নিজের তল্পিতল্পা নিয়ে হাঁটা দিলেন। ভাগ্যে একজনের চোখে পড়ল, সে তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? রামকৃষ্ণ বললেন, কেন, আমায় চলে যেতে বলেছে যে। সে বলল, আপনাকে না, হৃদয়কে। এ ঘটনা যেমন আছে, তেমন আছে নেমন্তন্ন করে খেতে না ডাকার গল্পও। যাও বা বলে-কয়ে খাওয়ার জায়গা পাওয়া গেল তাও যেখানে সবাই জুতো খুলে রেখেছে তার পাশে। কোনো অভিযোগ নেই এ আনন্দময় পুরুষের। অন্যেরা অপমানিত বোধ করলেও তিনি ভাবছেন না যে তিনি ঈশ্বরের প্রথম সারির ভক্ত বলে তাঁর অতিরিক্ত কিছু খাতিরযত্নের ব্যবস্থা হওয়া উচিৎ, মানুষের তরফ থেকে না হলেও অন্তত ঈশ্বরের উচিৎ ছিল সবচাইতে উচ্চাসনটা তাঁর জন্য আগে থেকে সংরক্ষিত করে রাখা। গিরিশ খেতে খেতে উঠিয়ে দিলেও তাঁর আনন্দের সাগর সঙ্কুচিত হয়ে যায় না। পরেরদিন আবার নিজের থেকেই গিরিশের বাড়ি উপস্থিত হন; অনুশোচনায়, আত্মধিক্কারে মরমে মরে যাওয়া গিরিশকে আবার নিজের প্রাণের আনন্দে ডেকে আনেন আনন্দের উৎসবে।

      খেতে পাচ্ছেন না, তবু কোনো অভিযোগ নেই। অনেকে বলাতে একবার খালি বললেন, মা আমি খেতে পাচ্ছি না, গলায় বড্ড ব্যথা। মা দেখালেন শত-সহস্র মুখ দিয়ে তিনি খাচ্ছেন। ব্যস, আর কোনো কথা নেই, দুঃখ নেই সেই নিয়ে। মা কি দেখালেন আমরা জানি না, কিন্তু আমরা আবার দেখি অত কষ্টের মধ্যেও সেই আনন্দময় ছবি। এমনকি এও বলছেন, মাকে বললেই এই দেহত্যাগ হয়ে যায়, কিন্তু তোমাদের কষ্ট হবে, তাই বলতে পারি না, বলি আর কিছুদিন থাক এ শরীর। কথাটা এখানে ওনার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার না, ভালোবাসার দিকটা। যিনি এমন যন্ত্রণাকেও মেনে নিয়েছেন শুধু ভালোবাসার দায় স্বীকার করে। গেলেও যাওয়া যায়, তবু ক'দিন থাক।

      সত্যিই কি এ মানুষটার কোনো মিশন ছিল? সত্যিই কি উনি কারোর গুরু হতে এসেছিলেন? যিনি গুরুগিরিকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আক্রমণ করে বলেছিলেন – ও বেশ্যাগিরি। তবে কিসের জন্য রামকৃষ্ণের কাছে যাওয়া? এই আনন্দময় সত্তার কাছে শুধু আনন্দ নিয়েই যাওয়া। অনেক অভিযোগ, অভাব নিয়ে রামকৃষ্ণের কাছে গেলে কিছু মেলে কিনা জানি না, কিন্তু আনন্দের জন্য, শুধু আনন্দের জন্যেই বারবার যাওয়া। সে আনন্দময় সত্তায় অবগাহনের জন্য। আনন্দেই মানুষ পূর্ণ। আনন্দেই মানুষ সার্থক। আনন্দেই কৃতকৃত্য।

 

(শিল্পী ~ নন্দলাল বোস)