Skip to main content

Isolation - বিচ্ছিন্ন রাখা না থাকা?
         মনের ধর্ম কি? বিচ্ছিন্ন থাকতে চাওয়া? কিছু কারণে কখনও কখনও হয়ত চাইলেও মূলত তা মনের ধর্ম কি? আসলে কথাটা 'isolation' বললে মনের যে বোধের সাথে যায়, 'বিচ্ছিন্ন' বললে তা যায় না। ছিন্নমন বা ছিন্নসত্তা বলি যদি? হ্যাঁ কতকটা আমার মনের ভাবের রস পেল। তবে এই কথাটাই থাক – ছিন্নমন বা ছিন্নসত্তা।
        আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এই ছিন্নমনের বাস। কিছুটা অংশ জুড়ে। যার যত বেশি তাকে তত অন্তর্মুখ, লাজুক বলা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অহংকারী বা ঘ্যাম বা অ্যাটিচিউড দেখানোও বলা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত আলোচনায় পরে আসছি। আগে আমাদের দেশের অতীতে এই মনোভাবের কিছুটা তাকিয়ে দেখি।

ভারতীয় সমাজের গল্প
--------------------------------
“মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে,
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।”
~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

        ভারতের সাধনা অন্তর্মুখের সাধনা। তার শাস্ত্র বেশিরভাগই মুক্তির কথা বলে। যার মূল সাধন এই ছিন্ন হওয়ার চেষ্টায় রত হওয়া। গীতা বললেন এক জায়গায় --- ‘বিবিক্তদেশসেবিত্বমরতির্জনসংসদি’, অর্থাৎ কিনা অধুনা রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় ‘নির্জনবাস’, বা সেই শ্যামাসঙ্গীতের মত – ‘ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়’, কিম্বা স্বামীজির প্রিয়গান, ‘মন চল নিজ নিকেতনে’। মোদ্দা কথা ‘ভেন্ন হও’, ‘একলা হও’, মনের মধ্যে টুলটুল করে চেয়ে থেকে থেকে আত্মার জ্যোতিখান খোঁজো। ভারত দীর্ঘদিন ধরে সে আত্মার জ্যোতি খুঁজল। কি পেল তা আজও বুঝলাম না। তবে স্বামীজি ইত্যাদির মত প্রাচ্যদূতেরা যখন পাশ্চাত্যে জয়জয়কার তুলে এলেন, আমাদের যেন বোধ হল, ‘যাক এতদিনের প্রাচ্যের সাধনার একটা মুখরক্ষা হল’। কথাটা হল আত্মার মাহাত্ম্যে বিশ্বাস না থাকুক, পাশ্চাত্যের মাহাত্ম্যে তো আর চোখ বন্ধ করে শূন্য খোঁজার বালাই নেই, চোখ চাইলেই জলের মত স্পষ্ট। তখন আর ‘মায়ের দেওয়া মোটা’ কাপড়ের দেশপ্রেম মোহ কদ্দিন টেকে রে ভাই?
        টেকেও নি। না ওদের, না আমাদের। যতই আমাদের মহাপুরুষগণ আমাদের দর্শনের বড়বড় কথা বলে আসুন না কেন, আদতে তো আমাদের ২০১৭ -তেও 'মাঠে হেগো না রে বাপু’ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানাতে হয়, স্বচ্ছ অভিযান চালাতে হয়, সে আমাদের চিত্তশুদ্ধির যতই কারনামা থাকুক না কেন। ফলে ওরা যখন আমাদের দেশে ঘনঘন যাতায়াত শুরু করল, নিজেদের বোধশক্তি অনুযায়ী ভারতকে বুঝতে শুরু করল, তখন সে ‘আত্মারামের’ মাহাত্ম্যর ভুতও ঘাড় থেকে নামল। তবে ওরা গুণীর কদর সে কালেও করেছে, আজও করে আসছে। সেটা ওদের উদারতার জন্যে তো অবশ্যই।
        তো যেটা কথা হচ্ছিল, আমাদের মূলকথা হল বিচ্ছিন্ন হও মূলধারা থেকে, আত্মপোলব্ধি করো ইত্যাদি। এই ভাবটা আজও আমাদের রক্তে প্রচ্ছন্ন বয়ে চলেছে। তিন দিকে সমুদ্র আর এক মাথা হিমালয় নিয়ে সেদিন যে কাজটার সুবিধা হয়েছিল, আজ আর হচ্ছে না, তাই পারা চড়ছে। কারণ দীর্ঘদিন ছিন্নসত্তায় থাকলে তো বিকার আসা স্বাভাবিক, তাই দীপিকার মুণ্ডুর দাম একলক্ষ হয়ে দাঁড়ায় ‘পদ্মাবতী’র জন্য। যারা করছে তারা তো নিজেদের 'আপামর জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন বিশেষ প্রজাতির মানবকূল' বলে দীর্ঘদিন ধরে ভেবে এসেছেন, অভ্যাস হয়ে গেছে যে!
        ভাবেন আজ যদি আম্বেদকরের হাতে না পড়ে, বর্ণাশ্রমে পূর্ণ আস্থাবান কোনো মহাত্মার হাতে গিয়ে আমাদের সংবিধান বানানোর ভার পড়ত। কি হত? আমাদের আবার হয়ত কয়েকশ বছর অপেক্ষা করতে হত এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। কারণ মনে রাখবেন আমাদের সে যুগের গুরুদের থেকে আজকের কর্পোরেট গুরুরাও কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই বর্ণাশ্রমের ধামাধারী। সেই বর্ণাশ্রম, যা আমাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবাদের সুচারু, সুপরিকল্পিত, নিষ্ঠুর, বর্বর প্রকল্প। আসলে তো আমরা সেইদিনই আত্মধ্বংসের শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছিয়েছি যেদিন একজন মানুষকে তার মজ্জায় মজ্জায় বিশ্বাস এনে দিতে পেরেছি – সে নীচ, সে অস্পৃশ্য।
        একটা দেশের মধ্যে কোনোদিন একতা তৈরি হয়নি। তা হবেটা কি করে? বুদ্ধি-যুক্তির অগম্য কোনো কারণের উপর নির্ভর করে যদি মানুষে মানুষে ভেদ তোলার স্থায়ী বন্দোবস্তকে একটা সমাজ মাথায় তুলে রাখে সে সমাজে বিষবৃক্ষের বীজ অঙ্কুরিত হবে না? যার প্রথম বিদ্রোহী সন্তান ছিলেন বুদ্ধ, যার আশ্রয় নিয়েই অবশেষে আম্বেদকরজীকেও এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল উৎপাটনে ব্রতী হতে হল। ইদানীং কেরলের একটা মন্দির অসামান্য একটা কাজ করলেন, তারা দশজন তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষকে পূজারীপদে আভূষিত করলেন। তবু এ কিছুই না, এত হাজার হাজার বছরের ‘পবিত্র’ ‘দেশের হিতোকারক’ অভ্যাস, একদিনে তো আর যাবে না। তাই খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের পাতাটা খুললেই বোঝা যায়, যিনি যত উচ্চশিক্ষিত, আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত হোন না কেন, সমগোত্রীয় না হলে বিপদ। আমি এমন বহু দীক্ষিত বাড়ির মানুষকে দেখেছি যারা অন্যের হাতের খাবার খান না, তাতে নাকি তাদের সত্তাহানী হবে। এমন নিষ্ঠুর বর্বরোচিত ব্যবহারকে 'ধর্ম' বলে চালাতে আমাদের দেশের গণ্যমান্যেরাই পারেন। এবং স্বমহিমায় চালিয়েও যাচ্ছেন। “তুমি কি বেশি বোঝো বাবা! অমন ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের বচন মিথ্যা হয়?” কতদিন স্বপাকে খেলে আর কতটা বীর্য্য জমালে যে পরমাত্মা খুশী হয়ে সেলফি পাঠাতে রাজী হন তা জানলে না হয় একবার চেষ্টা করে দেখতুম।
        এরকম নানান অভূতপূর্ব প্রণালীতে এই বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা আমাদের সমাজে হয়েছে, হয়েও চলেছে।

ব্যক্তিগত ছিন্নমন তথা ছিন্নসত্তা
---------------------------------------------
“Loneliness and the feeling of being unwanted is the most terrible poverty… no one to anyone” ~ Mother Teresa.
        ছিন্নমন ছিন্নসত্তা থেকে একাকীত্ব জন্মায়। কিন্তু কেন এই বিচ্ছিন্নতা? নানা কারণ হতে পারে। একটা প্রধান কারণ অবশ্যই বয়েস ও শারীরিক অসুস্থতা। দ্বিতীয়টার মারাত্মক বর্ণনা কামুর বিখ্যাত উপন্যাস ‘প্লেগ’ আর দস্তয়েভস্কির ‘Notes from the underground’. হাস্পাতালের সম্পর্ক তাই কখনও বেশিদূর গড়ায় না। সে চূড়ান্ত একাকীত্ব, সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একার মধ্যে একা শারীরিক যন্ত্রণার সাথে লড়া। ক্রমে আশেপাশের মানুষের সহানুভূতিতে ভাঁটা পড়তে থাকা, নির্মম একাকীত্বের গ্রাসে ধীরে ধীরে লয়প্রাপ্ত হতে হতে মৃত্যুর মধ্যে মুক্তি খোঁজা। হাস্পাতালে চিকিৎসাধীন মানুষটার সকাল-বিকাল জানলার দিকে তাকিয়ে থাকা মুখের মত করুন, শূন্যদৃষ্টির মত অসহায় যন্ত্রণা খুব কমই দেখিনি কি?
        আরেকটা কারণ দূরত্ব। দূরত্বটা কিলোমিটারের উপর নির্ভর করে না, করে যানবাহনের সুযোগ-সুবিধার উপর। বাড়ি থেকে বারো কিলোমিটার দূরের চরসরাটি যাওয়ার থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে কলকাতায় যাওয়া অনেক সোজা আমার কাছে। কারণ চরসরাটি যাওয়ার কোনো সহজলভ্য উপায় নেই। বহু ছিন্নমনের জনক এই অসুবিধা। চাইলেই কোথাও যাওয়া যায় না। বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলগুলোতে এ অসুবিধা আরো প্রকট। অনেক যুবক যুবতীর পক্ষে এটা হানিকারক দেখেছি। সুযোগের অভাব। এইসব অঞ্চলে এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা যায়। বড় শহর থেকে যত দূরত্ব, এই ধরণের বিচ্ছিন্নতাজনিত সমস্যার শিকার যুবক যুবতীর সংখ্যা তত বেশি। কারণ বৈদ্যুতিক বিজ্ঞাপন ও ইন্টারনেটের দৌলতে বড় শহরে প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা, আমোদপ্রমোদের খবরাখবর জানা যাচ্ছে, কিন্তু তাতে অংশ নেওয়া যাচ্ছে না, এ এক চূড়ান্ত বিকার উৎপাদক অবস্থা।

        আরো নানা কারণ তো আছেই। তার মধ্যে আরেকটা বড় কারণ প্রিয়জনের মৃত্যু বা বিচ্ছেদ। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলি। মা চলে যাওয়ার পর আমার অশৌচ পালনের পালা এলো। আমি না মানলেও 'সমাজের যারা মানে তাদের মানসিক অসুবিধার কথা ভাবতে হবে' --- এমনি বলা হল। শুভ উৎসবে যাওয়া যাবে না, মন্দির এড়িয়ে যেতে হবে ইত্যাদি। বেশ কয়েকমাস পর থেকেই আমার নিজেকে নিয়ে কেমন একটা অস্বস্তি হতে শুরু করল। বাজার ঘাট, লোকারণ্য অঞ্চল এড়িয়ে যেতে থাকলাম। মনে হত আমায় দেখলেই কারোর কোনো ক্ষতি হবে, ফলে বন্ধুবান্ধবদের এড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করতাম। ক্রমশঃ যেন একটা বিকার আমায় পেয়ে বসতে লাগল। একবার মনে হল বাইরে কোথাও কাটিয়ে আসি, আমার কিছু পরিচিত মানুষ জয়রামবাটী যাচ্ছিলেন, ভাবলাম ওদের সাথে যাই, মনের যে তীব্রশূন্যতাবোধ তার কিছুটা হয়ত মিটবে। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ সারদার পথে তো আর সংকীর্ণতার কথা নেই। কিন্তু সেখান থেকে উত্তর এলো আমি এই অবস্থায় সেখানে থাকতে পারব না। বুঝলাম দশখণ্ড বিবেকানন্দ রচনাবলী, কথামৃত, লীলাপ্রসঙ্গ, শতরূপে সারদা – এসব সাহিত্য মাত্র। পরিবর্তন না সমাজে, না সাধকের হৃদয়ে।
        নিজেকে একা করে নিতে নিতে ক্রমশঃ অসুস্থতায় এসে পড়তে লাগলাম। আমাকে বাঁচালো দুজন – এক, কবিতা, আর দুই, কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল কি তুচ্ছ বিকারের কবলে আমার মস্তিষ্ক, আমার হৃদয়! পথ খুলল কবিতা। বুঝলাম ভুল বোঝানো হচ্ছিল আমাকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, যারা দূরে রাখছে আমার অশৌচের ভয়ে আমায় তাদেরই চোখের উপর চোখ রেখে দেখি। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বাঁচার কথা আর মনেও আনব না। তাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে বুঝলাম ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ ছাড়া তাদের ঝুলিতে সম্বল বলতে তেমন কিছু নেই। তারা সব চাইতে বেশি ভয় পায় ভুল করতে আর ব্যর্থ হতে। তাদের উপর মায়াই হল, এর থেকে বড় ব্যর্থতা মানুষের জীবনের আর কি হতে পারে, নিজের বুদ্ধি-বিচার বন্ধক দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানো আর লোককে সে মোড়কে ভরার চেষ্টা করার মত?

        বাহ্যিক কোনো কারণে যদি নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়, তার জন্যে উপায় হয়ত অনেক সময় নাও মিলতে পারে। সে অবস্থাটার সাথে মানিয়ে নিয়ে অথবা লড়াই করে অপেক্ষা করা ছাড়া সমাধানের পথ নেই হয়ত বা। কিন্তু বাকি সব বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ অজ্ঞানতা। এটা এক্কেবারে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। সে অজ্ঞানতা সমাজের যুগসঞ্চিত শাস্ত্রের অচলায়তন হোক, কিম্বা বিকারের দুর্ভেদ্য প্রাচীরই হোক। এ বিকার দু'প্রকার হয় – হীনমন্যতা আর অতিমান্যতা। দুটোই সাংঘাতিক ক্ষতিকারক। হীনমন্যতা বাড়ির সামনে শ্যাওলার চাষ করে, আর অতিমান্যতা পাঁচিল তুলে তুলে আলো বাতাস রোধ করে।
        বাকি ধনী দরিদ্র, মানী অমানী ইত্যাদির পার্থক্য আর বিচ্ছিন্নতাটা সমাজ যত ভদ্র হয় তত লোপ পেয়ে যায়। পাশ্চাত্যে ওদের এই বিচ্ছিন্ন অধিবাসীর সংখ্যার একটা মাপ আছে, যার বাড়ন্ত লেখচিত্র সমাজবিদদের ভ্রূকুটি তুলছে। আমরা আত্মতুষ্টিতে এখনও ভুগে চলেছি? একাকীত্ব? ফুঃ। ওসব নিয়ে আমরা ভাবি না। একা এসেছিস, একাই যাবি... বুঝলিরে পাগল!