Skip to main content

ধর্ম কখনও মূল্যবোধ শেখায় না। কখনও কখনও মূল্যবোধের বহিরাবরণ গড়ে দিতে সাহায্য করে। তাও বাস্তবে খুব কমক্ষেত্রেই। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অন্তঃসারশূন্য বহিরাবরণ নিয়ে এত মোহ, এত দলাদলি।

মানুষ মৃত্যুতে ফুরিয়ে যায় না। মূল্যবোধহীন হলে বেঁচে থাকতেই ফুরিয়ে যায়। মূল্যবোধ জন্মায় যন্ত্রণায়। খিদের মত, তেষ্টার মত যন্ত্রনায়। একটা সময় সব কিছুর উপর বিশ্বাস হারিয়ে, উদ্দেশ্যহীন হয়ে, একে তাকে, সব ঈশ্বর-দেবতাকে প্রশ্ন করে ক্লান্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, তবে দাঁড়াই কোথায়। বাইরের কাউকে না, নিজেকে জিজ্ঞাসা করে। আর তখনই ভিতর থেকে নির্দেশ আসে এক অনাদিকালের মূল্যবোধের উপর - শ্রদ্ধা। জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা। বাকি যা কিছু ভালো সেখান থেকে শুরু। সেই শ্রদ্ধাকে হারিয়ে ফেললে সব ফাঁকি। যত ঢক্কনিনাদ করি না কেন, যতই দলবল নিয়ে এসে সময়ের চাকা ঘোরাতে চাই না কেন, যতই কথার চাতুরীতে ভুলাতে চাই না কেন। অবশেষে সব মিথ্যা। যদি জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাটা না থাকে। জীবনের কোনো ধর্ম হয় না। জীবন থেকে ধর্মবোধ জন্মায়। তাই সনাতন ধর্মের সংজ্ঞা বুদ্ধ দিচ্ছেন, বৈরিতা দিয়ে বৈরিতাকে জয় করা যায় না, বৈরিশূন্যতা দিয়েই বৈরিতাকে জয় করা যায় - এই সনাতন ধর্ম।

আমি শত্রুতা ছাড়লে শত্রুতা নাশ হয় না। কিন্তু আমার ভিতর শত্রুতা শূন্য হলে আমি জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাকে গ্রহণ করি। সেই আমার মূল্যবোধ। সেই থেকেই যা কিছু সত্য, মঙ্গল। তার নাম যদি দিই ঈশ্বর, তবে সে সত্যিই অবিনশ্বর। কারণ এ মূল্যবোধ অবিনশ্বর। জীবন যত বড় ঘূর্ণিতেই ফেলুক না কেন ধ্রুবতারা তো এই, জীবনের উপর শ্রদ্ধা, তাই যে করেই হোক আবার সেদিকে ফেরার রাস্তা খুঁজে বার করতেই হবে। জীবনই একটা শব্দ, যেখানে আমি তুমি থেকে শুরু করে দুর্বলতম প্রাণীটকেও যুক্ত করে নিই।

সৎ সাহিত্য এই কাজটাই করে। সৎ সাহিত্যের কাজ মূল্যবোধকে চাপিয়ে দেওয়া না। সৎ সাহিত্যের কাজ মূল্যবোধকে আবার নতুন করে অন্বেষণ করা। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেইখান থেকেই খোঁজা। সে প্রাচীন থেকে নবীন, ধর্ম থেকে শিল্প যা-ই হাতের কাছে পায় নেড়েচেড়ে দেখে। খোঁজে কোথাও পথের কোনো সূত্র আছে কিনা। যতটুকু পায়, রাখে। যতটুকু না পায়, সরিয়ে দেয়।

মূল্যবোধ যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এক সময় প্রয়োজনবাদ বা utilitarianism সে কথা বলতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। আসলে মানুষের মূল্যবোধ মানুষ হিসাবে পূর্ব নির্ধারিত। কিসের উপর নির্ধারিত তা আমরা জানি না। কিন্তু জানি না বলেই সেই ক্ষুব্ধ অহংকারে তাকে আমার সৃষ্টি বলে দাবী করা মূঢ়তা। মানব সভ্যতার যাত্রাপথ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা তৈরি হয়নি শুধু, তার গভীরে থাকা মনুষ্যত্ববোধই আসল কারিগর। যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু যা দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করা যায় সদর্থে।

সৎ সাহিত্যের কাছে ঋণ আমাদের তাই অপরিসীম। কোনো মূল্যবোধকেই চাপাতে চায়নি। বারবার খোঁজ করেছে বলেই। যার মূল সুর জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা।

আজ কৃষ্ণা সোবতির মৃত্যুদিন। আশাপূর্ণা দেবী থেকে কৃষ্ণা সোবতির এই অন্বেষণ আমাদের দীর্ঘদিন সঞ্জীবিত রাখবে। বারবার বলবে, শুধু একটা স্বচ্ছ দৃষ্টিই দরকার। আলো দেখা যাবেই।