Skip to main content
01

স্বামীজী চিঠিতে লিখছেন, "ভোগের নামে সবাইকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না। দুটো ফিল্টার তৈয়ার করবে। সেই জলে রান্না খাওয়া দুই-ই। ফিল্টার করবার পূর্বে জল ফুটিয়ে নেবে, তাহলে ম্যালেরিয়ার বাপ পলায়ন। সবার স্বাস্থ্যের উপর প্রথম দৃষ্টি রাখবে।"

আমার খটকা লাগল। ম্যালেরিয়ার সঙ্গে জল ফোটানোর কি সম্পর্ক? ম্যালেরিয়ার তো 'ম্যাল এয়ার' মানে দূষিত বায়ু শব্দ থেকে এসেছে। তবে জলের প্রসঙ্গ কেন?

স্বামীজী চিঠিটা লিখছেন 1895 সালে । যেখানে ম্যালেরিয়া সম্বন্ধে প্রথম জানাচ্ছেন ডাক্তার অ্যালফানস্ ল্যাভেরন 1880 সালে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে দুটো আলাদা লেখায় একাডেমী অফ্ মেডিসিন "Parasite Found in the Blood of Several Patiatients Suffering from Marsh Fever." 'Marsh fever' বলতে ম্যালেরিয়া বোঝানো হত। কারন Kent & Essex নামক জায়গায় অত্যধিক জলাভূমিজনিত কারণে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ অনেক বেশি ছিল।

কিন্তু ল্যাভেরানের কথা তখনকার ইতালির বিজ্ঞানীরা মানতে নারাজ হন। তাদের ধারণা ছিল ম্যালেরিয়া জল ও মাটিবাহিত কোন ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। 'ব্যাসিলাস ম্যালেরি' নামে এক ব্যাকটেরিয়ার কথাও উল্লেখিত হয়। অবশেষে ল্যাভেরান লুই পাস্তুরের দ্বারস্থ হন, এবং তিনি স্বীকার করেন। 1907 সালে ল্যাভেরণ তার কাজের জন্য নোবেল পান, যদিও তার আগে 1902 সালে রোনাল্ড রস নোবেলে ভূষিত হয়েছেন ম্যালেরিয়ার সঙ্গে মশার ও মশা-বাহিত প্রোটোজোয়ার সম্পর্ক প্রমাণিত করে, যা ল্যাভেরান দ্বারা প্রস্তাবিত ছিল। অবশ্য আরেকজনের নাম উল্লেখ্য --- প্যাট্রিক ম্যানসন।

রোনাল্ড রস কবি মানুষ ছিলেন। বাইবেলের দুটো লাইনের অনুষঙ্গ যা তার কবিতার শেষে ব্যবহার করেছেন সেকি ম্যালেরিয়া জয়েরই অনুষঙ্গে?

 

This day relenting God

Hath placed within my hand

A wondrous thing; and God

Be praised. At his command,

Seeking his secret deeds

With tears and toiling breath,

I find thy cunning seeds,

O million-murdering Death.

I know this little thing

A myriad men will save,

O Death, where is thy sting?

Thy victory, O Grave?

 

রবীন্দ্রনাথ ম্যালেরিয়ার উপরে দুটো ভাষণ দিয়েছিলেন ম্যালেরিয়া নিবারণী সভাতে, যথাক্রমে 1922 এবং 1923 সালে। ডাক্তার গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই সময় ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য বিশেষভাবে তৎপর হন। উনি স্বনামধন্য ব্যাক্টিরিওলজিস্ট ছিলেন। লান্সেট-এর মতো পত্রিকাতেও ওনার লেখা প্রকাশিত হত। 1918 সালে 'ম্যালেরিয়া নিবারণ সভা' প্রতিষ্ঠা করেন। রোনাল্ড রস-কেও আমন্ত্রণ জানানো হয়, যিনি গোপাল বাবুর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন।রবীন্দ্রনাথ এই সভাতেই পৌরহিত্য করতে গিয়ে বলেন---

"এইটে আপনারা বুঝতে পারেন, পতঙ্গে মানুষে লড়াই। আমাদের রোগশত্রুর বাহনটি যে ক্ষেত্র অধিকার করে কাছে সে অতি বিস্তীর্ণ। এই বিস্তীর্ণ জায়গায় পতঙ্গের মতো এত ক্ষুদ্র শত্রুর নাগাল পাওয়া যায় না। অন্তত ২/৪ জন লোকের দ্বারা তা হওয়া দুঃসাধ্য, সকলে সমবেতভাবে কাজ না করলে কিছুই হতে পারে না। আমরা হাৎড়াচ্ছিলাম, চেষ্টা-মাত্র করছিলাম, এমন সময় আমার একজন ভূতপূর্ব ছাত্র, মেডিকেল কলেজে পড়ে, আমার কাছে এসে বললে, "গোপালবাবু খুব বড়ো জীবাণু-তত্ত্ব-বিদ্‌, এমন-কি ইউরোপে পর্যন্ত তাঁর নাম বিখ্যাত। তিনি খুব বড়ো ডাক্তার, যথেষ্ট অর্থোপার্জন করেন। আপনারা ম্যালেরিয়ার সহিত লড়াই করতে যাচ্ছেন, তিনি সে কাজ আরম্ভ করেছেন; নিজের ব্যবসায়ে ক্ষতি করে একটা পণ নিয়েছেন -- যতদূর পর্যন্ত সম্ভব বাংলাদেশকে তার প্রবলতম শত্রুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করবেন।' যখন এ কথা শুনলাম, আমার মন আকৃষ্ট হল। আমাদের এই কাজে তাঁর সহায়তা দাবি করতে সংকল্প করলুম। মশা মারবার অস্ত্র পাব এজন্য নয়; মনে হল এমন একজন দেশের লোকের খবর পাওয়া গেল যিনি কোনরকম রাগ-দ্বেষে উত্তেজনায় নয়, বাহিরের তাড়নায় নয়, কিন্তু একান্তভাবে কেবলমাত্র দেশের লোককে বাঁচাবার উপলক্ষে, নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে, নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন করে কাজ করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন -- এইরূপ দৃষ্টান্ত বড়ো বিরল। আমার মনে খুব ভক্তির উদ্রেক হল বলে আমি বললাম, তাঁর সঙ্গে দেখা করে এ বিষয় আলোচনা করতে চাই। এমন সময় তিনি স্বয়ং এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন, তাঁর কাছে শুনলাম তিনি কী ভাবে কাজ আরম্ভ করেছেন। তখন এ কথা আমার মনে উদয় হল, যদি এঁর কাজের সঙ্গে আমাদের কাজ জড়িত করতে পারি তা হলে কৃতার্থ হব, কেবল সফলতার দিক থেকে নয় -- এঁর মতো লোকের সঙ্গে যোগ দেওয়া একটা গৌরবের বিষয়।

উনি আরও বলেন, "দেশে মশা আছে এটা বড় সমস্যা নয়, বড় কথা এই দেশে লোকের মনে জড়তা আছে, সেটা আমাদের দোষ, বড় রকম দুঃখ বিপদের কারণ সেখানে…. কতরকম ব্যাধি-বিপদ আছে যদি ব্যক্তিগত কয়েকজন লোকের উদ্যমকে একমাত্র উপায় বলে গ্রহণ করি তাহলে আমাদের দুর্গতির অন্ত থাকবে না।"

হঠাৎ ম্যালেরিয়া নিয়ে পড়লাম কেন? কথাটা আসলে ম্যালেরিয়া নয়। ম্যালেরিয়া একটা উপলক্ষ। স্বামীজী, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা প্রমুখেরা তখন যে শুধু দেশের অধ্যাত্মিক তথা জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি নিয়েই মাথা ঘামাছেন তা তো নয়। একদম প্রাথমিক স্তরে এসে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়েও সচেতন হতে বলছেন। মহাত্মার বহু-ব্যবহৃত শব্দ 'সর্বোদয়' এই অর্থেই সার্বিকভাবে একজন মানুষের উন্নতির উদ্দেশ্যে।

এনারা প্রত্যেকেই ভারতীয় সমাজের যে সমস্যাটার কথা বলেছেন তা হল এই মানসিক জড়ত্ব এবং আত্মশক্তির উপর একান্ত অশ্রদ্ধা। দৈনিক জীবনে বাহ্যিক শুচিতা এবং আত্মশক্তির বিকাশে নৈতিক শুচিতাই যে একমাত্র অনুশীলনী সে এদের লেখায় বারবার উঠে এসেছে। নাহলে অণুজীব বিশেষজ্ঞ গোপাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিশ্বকবি তথা ঋষি দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের কাজের ক্ষেত্র এক হয়ে যায় কি করে?

স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে গ্রামে গ্রামে সচেতনতা আরো দরকার। শহরেও এখানে ওখানে পিক ফেলবেন না, থুতু ফেলবেন না, ডাস্টবিন ব্যবহার করুন ইত্যাদি সবই এই একই স্বাস্থ্যবিধির উল্লেখ। আরো অনেক রাস্তা বাকি। বিজ্ঞানের কাজ শুধু নয় এটা, সঙ্গে দরকার শুভ ইচ্ছা আর সচেতনতা। এখন যেমন সব চাইতে বড় থ্রেট, ডেঙ্গু। শুনলাম ডেঙ্গু নিয়ে নাকি গান বাঁধা হচ্ছে। সচেতনতার জন্য। এত এত মহাপুরুষ অতীত হয়ে গেলেন, কিন্তু মশা আর মশা নিয়ে আতঙ্ক আমাদের ছেড়ে গেল না।

02

03

 

04