যীশুখ্রীস্টকে যারা মেরেছিল আর যে মারার আদেশ দিয়েছিল, তারা সবাই জানত তারা ঠিক নয়। এমনকি তার নামে যারা নালিশ করেছিল তারাও জানত তারা ঠিক নয়। কিন্তু ঠিকটা কি তাও তারা বুঝতে পারছিল না। স্বার্থবুদ্ধিতে বিবেক দুর্বল ছিল বলে। বিবেক দুর্বল ছিল, ঘুমিয়ে তো ছিল না। তারা বুঝেছিল যে মানুষটাকে তারা মারতে চাইছে সে তাদের সবার থেকে উন্নত। কিন্তু তাও তারা মারতে চাইছে কারণ ঠিকটা কি তারা বুঝতেই পারছে না। যদিও জানে তারা নিজেরা ঠিক নয়।
এমন সময় আমাদের সবার জীবনে আসে। যখন আমরা জানি আমরা যেটা ভাবছি, কি বলছি, কি করছি, সেটা ঠিক নয়। কিন্তু ঠিকটা কি সেটাও তো জানি না স্পষ্ট করে। খ্রীষ্ট সরল চোখে তাকিয়ে থাকে আমাদের বিবেকের দিকে। ভালোবাসা শোনা শব্দ। কিন্তু বিবেকে জাগে কই? সহিষ্ণুতা, ক্ষমা জানা শব্দ, কিন্তু প্রেরণা আসে কই? ওগুলো বড্ড বোকাবোকা সেকেলে ধারণা যেন। বড্ড বইয়ের মত ঠিক, কিন্তু জীবনের মত ঠিক তো নয়। কিন্তু এও জানি আমিও ঠিক নই গোটাগুটি।
যেটা আসলে ঠিক, সেটা এত সরল যে তাকে মেনে নেওয়া যায় না। এত সরল যে ভাবতেই হাসি পায়। আমি নাকি সব ক্ষমা করে দেব? আমি নাকি সব সময় সত্যি কথা বলব? আমি নাকি ভালোবাসব, যে ক্ষতি করেছে তাকেও?
বোকার মত কথা। বোকার মত ভাবনা। বইয়ের মত সত্যি। জীবনের মত নয়। তবু আমিও যা করছি জানি সে জটিল, সেও পুরোপুরিভাবে ঠিক নয়।
কিন্তু একটা কিছু তো ঠিক করে নিয়ে চলতে হবে। তখন আসে সুবিধার ঠিক। কিন্তু যাতে আমার সুবিধা তাই যে সব সময় ঠিক নয়, সেকি আমি জানি না? জানি তো। কিন্তু ঠিকটা কি যখন জানি না, তখন সুবিধাটাই দেখি না কেন? ধীরে ধীরে এইভাবে আমি ঠিকের খোঁজ ছেড়ে সুবিধার দিকে ঝুঁকে পড়ি। সুবিধা ধীরে ধীরে আমায় কোমল করে তোলে। নরম করে তোলে। আমি ঠিক আর সুবিধা গুলিয়ে একাকার হয়ে তখন। আমার বিদ্যাবুদ্ধি সব তখন সুবিধার দিকে ঝুঁকছে। আমায় মারণ বেগে টানছে।
সমস্যা হল মানুষের স্বভাবকে নিয়ে। সে সুবিধার দিকে চূড়ান্ত মেরুতে পৌঁছে গেলেও ঠিকের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ঠিকটাকে খুঁজে বার করা তার ধর্ম। সে সুবিধার বিপরীতে গেলেও। অতিবড় পাষণ্ড হলেও সে ঠিকের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। যদি না সে উন্মাদ হয়। যদি না সে বিকারগ্রস্থ হয়। আমাদের শিক্ষা, সভ্যতার বুনিয়াদ বলে সুবিধা ছাড়ো, ঠিকের দিকে ফেরো। আমরা আমাদের চলতি শিক্ষা, ক্ষীণদৃষ্টি বিষয়বুদ্ধিকে উস্কে বলি সে সবের জন্য অন্যলোক আছে। আমি সে নই। মুখে বলি। কিন্তু প্রাণে জানি শুধু সময়ের অপেক্ষা। সুবিধার মেয়াদ ফুরাবে। ঠিক যা সে আবার জেগে উঠে তলব করবে, কৈফিয়ৎ চাইবে খুঁটিনাটি সব হিসাবের। কিন্তু সে তো শেষের কথা, তার আগে সুবিধার মধ্যে সুযোগ বুঝে ঘর বানাতে অসুবিধা কোথায়?
ততদিনে খ্রীষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়ে গেছে। যা ঠিক, তা নানা জটিলতায় গেছে হারিয়ে। এদিকে কি যেন মিলছে না। হিসাব? নাকি ঋণের বোঝা?
একদিন অপঘাতে সব শেষ হয়। নইলে প্রাণে জন্মায় গ্লানি। বিন্দু বিন্দু গ্লানি সহ্য করতে করতে বুকে জমেছে গ্লানির মেঘ। যে কোনো মুহূর্তে মেঘভাঙা বৃষ্টির মত ভাসিয়ে নেবে আমায় যেন। ক্লান্ত আমি। গ্লানির বোঝা সব চাইতে ভারি বোঝা। একদিনে জন্মায় না। তাই প্রথমে হিসাব পাওয়া যায় না। যখন অনুভবে ধরা দেয় তার ভার হয় অসহ্য। ক্লান্ত আমি তখন নিজের বিষণ্ণ দেহ-মন নিয়ে আসি সেই ক্রুশবিদ্ধ রক্তাক্ত বেদীর সামনে। হাতজোড় করে জিজ্ঞাসা করি তুমি আছ? আমি যে সরল সত্যটা অস্বীকার করে গিয়েছিলাম সেদিন, সেটাই আসলে সব চাইতে ঠিক সত্য ছিল। সরল সত্য। স্বাভাবিক সত্য। স্বাভাবিককে স্বাভাবিক জানতে কত জটিলতা পেরিয়ে এলাম। কি আশ্চর্য ছলনাময় জীবন!
অন্ধকারে প্যাঁচা ডেকে ওঠে। ক্রমে আকাশের সব তারা চলে যাওয়ার পর অবশিষ্ট থাকে শুকতারা, একা, এমনকি মিলিয়ে যায় ধ্রুবতারাও। পুবদিক আলোকিত হয়। অবশিষ্ট আয়ুটুকু সম্বল করে শিশিরে গলে যেতে যেতে তখন সে ভাবে, কেউ কোনোদিন বিশ্বাস করবে না জগতে একটা সরল সত্য আছে। অনন্তকাল ধরে আছে। সে আছে বলেই অনন্ত আছে। কি সে? আবার খৃষ্টের চোখের দিকে তাকায়। সরল সত্য দৃষ্টিতে সব স্নিগ্ধ হয়। অথচ এই একটা সরল সত্য বুঝতে কি অপরিসীম শক্তি নিয়ে সহজ হতে হয়। সূর্যের মত।