“Gandhi was inevitable. If humanity is to progress, Gandhi is inescapable... we may ignore him at our own risk” ~ Dr Martin Luther King Jr.
কোন বই আমার জীবনের ধারা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে যদি ভাবি, সেটা অবশ্যই মহাত্মাজীর 'আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ'।
তখন আমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। অনেক কিছুই পড়া হয়ে গেছে। কিন্তু কোথাও একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। যে জীবনটা খুঁজছি, তার আভাস তো পাচ্ছি, কিন্তু তাকে ধরতে পাচ্ছি না। এমন সময় একটা দূর্গাপূজোর আগে, আমার এক বন্ধুর বাড়ি গেছি। তার বাড়িতে তাদের বইয়ের আলমারিতে পেলাম বইটা। কিরকম একটা কৌতুহল জাগল। আবার একটা কুন্ঠাও। কারণ বেশিরভাগ বাঙালির মত আমিও ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি, নেতাজী ভালো লোক আর গান্ধীজী দুষ্টুলোক। নেতাজী'র জন্মদিনে পতাকা তুলে ভাষণ দিতে হয়, গান্ধীজী'র জন্মদিনে বেলা করে ঘুম থেকে উঠে একটা ছুটির দিন কাটাতে হয়। একটা সিনেমা দেখানো হয় হলিউডের বানানো, ওটাতে নাকি মিছিমিছি গান্ধী আছে, দু'তিনবার তো দেখেছিস, আর কত দেখবি?
তবু বইটা নিলাম। আমার মনে আছে আমি সেই পূজোটায় একদিনও বাইরে বেরোইনি। গোগ্রাসে গিলেছি বইটা। বইটা ক্রমে আমায় গিলেছে।
আজ অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। বহু ছাত্রছাত্রীকে বইটা উপহার দিয়েছি। আজও দিই। কেন? তার আগে দুটো ছোট্টো গল্প বলি।
এক
-------
তখন গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকায়। একটা আন্দোলন শুরু হচ্ছে। একটা নতুন ধরণের আন্দোলন। জেনারেল স্মার্ট বলছেন, এই গান্ধী নামক ব্যক্তিটির প্রতি মাসে কিরকম একটা মানসিক অসুস্থতা শুরু হয়, এবারও হয়েছে। এর আবার একটা নবীদের মত পাগলামি। সেই সময় গোখলে ওনার আন্দোলনের জন্য ভারত থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন। চাঁদা তোলা হচ্ছে সারা ভারত জুড়ে। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে প্রভাব ভীষণ বেশি। ইতিমধ্যে গান্ধীকে নিয়ে একটা নাটক পরিবেশিত হয়ে গেছে। ১৯১৩ সাল। রবীন্দ্রনাথ সদ্য নোবেল পেয়েছেন। তিনিই হলেন প্রথম সারির অনুদান দাতা, ১০০ টাকা পাঠালেন, বললেন, আমাদের দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় ভাইবোনেদের সংগ্রামের জন্য আমার ক্ষুদ্র অনুদান। এরপর আবার একটা চেক গেল কয়েক মাস পরেই। রবীন্দ্রনাথ গোখলের কাছে ক্ষমা চাইছেন সমস্ত বাঙালিদের হয়ে, কারণ সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজীর কাণ্ডকারখানায় সারা ভারতে সাড়া জাগলেও, বঙ্গবাসী নিরুত্তাপ ছিল।
দুই
------
দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন একটা ঘটনা। খাওয়া নিয়ে একদিন গান্ধীজী নিজের ছেলেদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বসেন উত্তেজনার বসে। কারণ ট্রেন ধরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে, একটা আন্দোলনে যোগ দিতে যাওয়ার কথা তার। ট্রেনে যেতে যেতে একটা চিঠি লেখেন নিজের ছেলেকে, ক্ষমা চাওয়া চিঠি, নিজের দুর্ব্যবহারের জন্য। তিনি লেখেন, আমি ভুলে ভরা, অসম্পূর্ণ একজন মানুষ, আমার ভুলগুলো দেখে শিক্ষা নিও, আর আগামী দিনে এমন ব্যবহার করলে আমায় সাবধান করে দিও।
দু'জন মানুষ ক্ষমা চাইছেন। একজন সদ্য নোবেল পেয়েছেন, যিনি নিজের ক্ষুদ্র অনুদানের জন্য আর বাংলাদেশের উদাসীনতার জন্য। আরেকজন যিনি ক্রমে বিদেশের মাটিতে ইতিমধ্যে জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন, তার নিজের ছেলের কাছে।
আমাকে এগুলোই বিস্মিত করেছে। এমনভাবে ক্ষমা চাওয়া যায়? হ্যাঁ যায়। ভারতে আর সব মহাপুরুষেরা আজন্ম মহাপুরুষ। আমি একমাত্র এনাকেই পড়েছি যেখানে আমি তাঁকে প্রতি পদে পদে নিজের ভুলগুলো স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে জানিয়ে যেতে দেখেছি। তিনি যখন মহাত্মা তখনও নিজের তীব্র কামুকতা নিয়ে লিখতে তাঁর অসুবিধা হচ্ছে না। সেগুলো তিনি না লিখলে আমরা কেউ জানতেও পারতাম না। তবু সত্যের কাছে তাঁর চূড়ান্ত দায়। কারণ সত্যই ঈশ্বর তাঁর সংজ্ঞায়। তাই সব লিখে যেতে হবে। কি করে তিনি রিপুর হাত থেকে লড়াই করে নিজেকে বাঁচাচ্ছেন, সেও লিখে যেতে হবে। কারণ তাঁর ওই আত্মজীবনীটা লেখার মূল উদ্দেশ্যই হল, আমি যখন পেরেছি, সবাই পারতে পারে। তাকে নির্ভীক, নম্র আর সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। এই অহিংসা।
সাধারণ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যে মানুষ নম্র, সে হয় ভীতু, নয় কোনো স্বার্থের মতলবে আছে, অথবা কোনো হীনমন্যতা - সে অর্থনৈতিক হোক কি সামাজিক অবস্থানগত। আত্মজীবনীটা আমার সামনে স্পষ্ট রাখল একটা জীবন, যে জীবনটা মতলবহীন নির্ভীক নম্র। এমন হয়? হয়। লুইশ ফিশার, যিনি ওনার সব চাইতে বিখ্যাত জীবনীকার, তিনি ওনার সাথে কাটিয়ে লিখছেন, একে আমি কার সাথে তুলনা করব? বর্তমানে বা বর্তমানের কাছাকাছি যত বিখ্যাত, ক্ষমতাশীল ব্যক্তিত্ব আছে কারোর সাথে কি এর মিল আছে? বলে ফিশার কিছু নাম করেছেন - চার্চিল, বিসমার্ক ইত্যাদি। এরকম নাম করতে করতে বলছেন, না, আমি যে মানুষটাকে দেখছি, তার সাথে মিল পেতে গেলে আমায় কয়েক হাজার বছর পিছনে যেতে হবে জেরুজেলামে। হ্যাঁ, এই কথাটাই লিখছেন লুইশ ফিশার যিনি গান্ধীজীর সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন বেশ কিছু কাল। আর বলছেন, আসলে গান্ধী যে কাজগুলো করে চলেছেন, যে নীতি নিয়ে চলেছেন, সেগুলো অত্যন্ত সরল, আমরা প্রত্যেকেই তা নিজেদের জীবনে পালন করতে পারি, কিন্তু করি না।
আসলে আমরা তর্কে জিততে ভালোবাসি, জীবনে না। তাই আমি আজও তর্কই শুনে আসছি। যেন সত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া সামনের মানুষটার জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্যই নেই। তার জীবনে কোনো ত্রুটি, কোনো ভুল নেই বলেই গান্ধীজীর কোনো ত্রুটি সে মানুষটা যেন ক্ষমা করতে পারছে না। পরে বুঝেছি, অহংকারের চাইতে বড় সত্যের সন্ধান পাওয়া জীবনে একটা পরম আশীর্বাদ। সবাই পায় না। তাই পূজো বা নিন্দা - এর কোন একটা পথ নিয়ে নেয়, তাতে আর যা হোক, নিজের জীবন দিয়ে কোনো সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার দায় থাকে না। বাক্য আর ভঙ্গীমাতেই সব সারা হয়ে যায়।
জীবনে চরম সংকট এলে রবীন্দ্রনাথ বলছেন বড় বড় মানুষের জীবনগুলোর দিকে তাকাও। তখন কোনো কিছু আর শক্তি দিতে পারে না। মনে রেখো, এই মানুষগুলো সারাটা পথ অনেক কাঁটা, অনেক যন্ত্রণা, অনেক অপমান, অনেক দুঃখ একা পেরিয়ে এসেছেন, তবু হেরে যাননি।
আমি যতবার এই মানুষটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, একটাই কথা প্রাণের মধ্যে বেজেছে, থেমে থাকলে চলবে না। বিশ্বাস রাখতেই হবে। বারবার মনে করিয়েছেন, মনুষ্যত্ব একটা মহান সমুদ্র, তার খানিক ক্ষুদ্র অংশ বিষাক্ত হয়েছে বলে সম্পূর্ণ সমুদ্রটার উপর আস্থা হারাতে নেই। আর ওদিকে শুনেছি, সেই মানুষটা তার জীবনের শেষ প্রবন্ধে লিখছেন, 'তবু মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ'।
আজ জীবনগুলো ব্রতহীন, আদর্শহীন। আমাদের জ্ঞান, আমাদের সম্পদ আজ মনুষ্যত্বের প্রয়োজনের চাইতে মানুষ নামক জীবটার দরজায় পসরা সাজিয়ে বসেছে। কারণ সেখানে নগদে সব মেলে হাতেনাতে তৎক্ষণাৎ। মনুষ্যত্ব দিন দিন হেলায়, দীনতায় তার শ্রী হারাচ্ছে। ধর্ম আর অধ্যাত্মিকতার নামে একটা উচ্চমানের শৌখিন চিত্ত-বিলাসিতায় পেয়ে বসেছে আমাদের। এতে সব আসছে, জীবনের গৌরবটা ছাড়া। মানুষ বলছে, অমন গৌরবে আমার কাজ নেই, মনুষ্যত্ব হাসছে। সে জানে এ জীবজ আস্ফালনের শেষে চূড়ান্ত হতাশা, ব্যর্থতা যখন গ্রাস করবে, তখন সে হাত বাড়িয়ে আবার বলবে, আমার অমৃত পান করার ছিল। কারণ ব্যর্থতা কোনো বাহ্যিক ঘটনা নয়, ব্যর্থতা একটা বোধ, একটা অনুভব। সেই দিন এই মানুষটার সামনে এসে আবার দাঁড়াতে হবে, যে বলবে, আমার জীবনটাই আমার বাণী। নিজের জীবনকে সুন্দর করে তোলাই সব চাইতে বড় শিল্প। গ্রামের বাড়িগুলোতে যাও, সেখানেই ভারতের প্রাণধারার উৎস। অকৃত্রিম আনন্দধারায় স্নান করো, নিজেকে আহুতি দিয়ে, আনন্দে, পূর্ণতায়। নির্ভীক হও।