দুশ্চিন্তা কিসের এত? আমার ভাবনাই শেষ কথা? তা তো নয়। আমার ভাবনার পরে আরো কিছু আছে। সে ভাবনা না, সে ঘটনা। যা ঘটে চলেছে। সেকি আমার ভাবনার অপেক্ষা করে? ঘটনা যা ঘটে চলেছে। অনাদিকাল থেকে শুরু করে আজ অবধি চলে যাচ্ছে। এই ঘটনাপ্রবাহকে একসঙ্গে বলা হল - সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়। তৈরি হচ্ছে, টিকে থাকছে কিছুকাল, তারপরে কালের স্রোতে ডুবে মিশে যাচ্ছে। একি আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে হচ্ছে? একি আমার সংকল্প-বিকল্প ভাবনার ধার ধারে? এই ঘটনাপ্রবাহের কোনো ক্ষুদ্র আবর্তে আমার এ জীবন। কয়েক পাকে এ-ও মিশে একাকার হয়ে যাবে।
এই ঘটনাপ্রবাহকে যদি ভালো করে কাছ থেকে বুঝতে যাই তবে তাকে বলি 'বিজ্ঞান'। 'বিজ্ঞান' আমার অস্তিত্বের গভীরে এমন কিছু সাংকেতিক নির্দেশ পেয়েছে যা আমার জন্মানোর আগে থেকেই ছিল, আমার ভাগ্যকে স্থির করেই এসেছি আমি, যাকে নাম দেওয়া হল জিন। সেই নির্দেশে কালের স্রোতে এই ‘আমি’ ঘূর্ণীতে কি খেলা খেলে চলেছে তার কতটা আমার হাতে? ক'টা খেলার উপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা আমার আছে? এদিক সামলাতে গেলে ওদিক আলগা হয়ে যায়। এদিক মুঠো করে আনলে ওদিকে সব ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়ানো কুড়ানোর খেলাও আমারই খেলা।
'বিজ্ঞান' একের পর এক তত্ত্ব আবিষ্কার করে আনে, আর ঘটনাপ্রবাহের দিকে আঙুল তুলে বলে, এই দেখো, এই দেখো, এ-ও এমন একটা সত্য, এমন একটা তত্ত্ব যা তোমার ভাবনার বাইরে। কত সূত্র, কত নিয়ম, কত বিধিব্যবস্থা। এর মধ্যে কেউ কেউ বলে বসে, এগুলো যখন জেনে গেছি তবে এসো না আমরা এই সূত্র দিয়ে ওই সূত্রকে নিয়ন্ত্রণ করি, এই তত্ত্ব দিয়ে ওই তত্ত্বকে দিই চেপে, এই বিধি দিয়ে ওই বিধিকে দিই বদলে।
শুরু হয়ে গেল আরেক খেলা। এই খেলায় আমাদের কত কি গেল বদলে। আমাদের সভ্যতা, আমাদের সাহিত্য, আমাদের জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী... সব গেল বদলে। আমরা বিজ্ঞানের নানা সূত্র, বিধি, নিয়মের মধ্যে এক খেলা নিয়ে মেতেছি। এতে আমাদের সব মিলে ভালো হচ্ছে না মন্দ হচ্ছে আমরা স্পষ্ট বুঝছি না। ছোটো করে দেখলে মনে হচ্ছে এই দেখো কত সুখ, এই দেখো কত সুবিধা, এই দেখো কত আমোদ। অমনি বড় করে দেখার চোখ বলছে, সত্যিই কি ভালো হচ্ছে? দেখো কত ক্ষতি হয়ে চলেছে সমস্ত পরিবেশ, পৃথিবীজুড়ে। তোমার আয়ুষ্কাল আর অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই বুঝি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি? ছোটো চোখ অভিমান করে বলে, তা না তো কি? বড় চোখ বলে, তার বাইরেও যে আছে কত কি। ভাববে না?
না ভাবব না। আমরা শুধু দুশ্চিন্তা করব, আমরা শুধু আমাদের লাভক্ষতির হিসাব করব। আমরা বড় চোখকে আমাদের লোভের রঙিন বসনে ঢেকে বলব, হুস! ম্যাজিক!
কিন্তু আমাদের আজ গভীর অসুখ। আমাদের মনে শরীরের নানা সূত্র, নানা তত্ত্ব, নানা বিধি জানতে জানতে আমরা নিজেকে এত জেনে ফেলেছি যে আমাদের বুকের মধ্যে সেই সুড়ঙ্গের মুখটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। সে সুড়ঙ্গ দিয়ে ‘জানা’ দিয়ে প্রবেশ করা যায় না, সে সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রবেশের পথ করে দেয় - অনুভব। যে অনুভব ধরা দেয় না, ধরা দিতে বলে। যে অনুভব কান্না, যে অনুভব হাসি, যে অনুভবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারলে সমস্ত জগতটাকে হাতের নাগালে এনে দেয়, সেই অনুভবের রাস্তাটা গেছে বন্ধ হয়ে। আমাদের শুধু এখন জানার খেলা। এই জানা দিয়ে ঘর সাজানো। শুধু সাজিয়ে যাওয়া, শুধু সাজিয়ে যাওয়া... রঙের পর রঙ। তোলার সময়টুকুও নেই আর। আর সেই সুড়ঙ্গের মুখ চাপা পড়ছে তো পড়ছেই।
সেইদিনে আমাদের বাড়ির দরজার সামনে এক পাগল এসেছিল। সে পাগল আমাদের বলে গেল টাকার সুখ আর দেহের সুখের বাইরে আরেক সুখ আছে, কেন বুঝবে না? তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, কিসের সুখ? সে বলল, মা-কে জানার সুখ। সবাই বলল, কে তোমার মা? সে চারদিকের সমস্তটা দেখিয়ে বলল, এই সমস্ত জুড়ে যে নিয়ম বিধি, সে সবের মধ্যে যে যোগসূত্র সেই তো আমার মা। তাকে বলা হল, সেই বিধিকে আমরা জেনে যাচ্ছি তো তিলে তিলে, একদিন সবটা জেনে যাব। সে হেসে বলল, একটা পিঁপড়ে চিনির পাহাড়ের থেকে একদানা চিনি মুখে নিয়ে ফিরছিল, আর মনে মনে ভাবছিল যে, একদিন গোটা চিনির পাহাড়টাই নিয়ে যাবে মুখে করে, তোমার তো কথা সেই রকম। যে নিয়ম বিধি খণ্ডে জানছ, সেই নিয়ম বিধি'র মধ্যে যে অনাদি যোগসূত্র, যে চেতনা, সেই তো আমার মা।
তাকে বলা হল, আমরা ওসব মানি না। সে পাগল তখন বলল, সে না হয় না মানো, কিন্তু বড় সুখ তো মানো? তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, বড় সুখ মানে কি গো? সে বলল, আনন্দ, ওগো তোমাদের এত দুশ্চিন্তা দেখে আমার মনে বড় কষ্ট হয়, কই আমার তো পেছনের কাপড়টুকু পর্যন্ত ছিল না, না ছিল তোমাদের মত এত সুখের জীবন, কিন্তু আমার তো এত দুশ্চিন্তা ছিল না। তোমাদের জীবনে সুখ আছে অঢেল, আনন্দ নেই। আমার মা-কে মানো চাই না মানো, আনন্দকে নাও, আনন্দকে নিতে গেলে বড় হও, ভাবনার বাইরে এসো, তাই তো আমার মায়ের আরেক নাম আনন্দময়ী, শুনেছ তো, এই খেলাও একটু খেলে দেখো না, মাইরি বলছি, ঠকবে না, এসে দেখো, একান্ত না পারো তো আমায় ডেকো মাঝে মাঝে, শিখিয়ে দেব।