Skip to main content

ক্রমশ এই বোধটা স্পষ্ট হচ্ছে, যে ভাবে মানব সভ্যতার গতিপথটা ভাবা গিয়েছিল ঠিক সেইভাবে এগোলো না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমশ বিচ্ছিন্নতাবাদ, মৌলবাদ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে। 'ধর্ম' শব্দটা একটা আতঙ্কের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যে কোনো জটিল পরিস্থিতিতে নিজের একটা অবস্থান নিজের কাছে বুঝে নিতে হয়। সেটা যতটা গভীর, মননসিদ্ধ হয় ততটা সার্বজনীন ও সত্যের কাছাকাছি অবস্থান করে। আজ নিজেকে নিজের মধ্যে সংহত করে, নিজের বিবেক-বিবেচনা-শিক্ষা-রুচির মিলিত অন্তঃসত্তার কাছে এই প্রশ্ন - তবে উপায় কি? 
প্রথম কথা, আমি 'সেক্যুলার' শব্দটার ব্যবহার জানলেও তার মর্মার্থ আর প্রয়োগ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। আমি এই লেখাটা লিখতে বসলাম তার একমাত্র কারণ নিজের চিন্তা আর অনুভবগুলোকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই বলে এই সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে। 'সেক্যুলার' শব্দটার সততা নিয়ে আমার একটা প্রশ্ন জাগে। মানুষের অভিব্যক্তির সাথে সাথে ধর্মের অভিব্যক্তি ঘটে চলেছে যুগ যুগান্ত ধরে। মানুষের মধ্যে একটা ধ্রুবের খোঁজ আছে। সে এমন একটা কিছুকে চায় যা শাশ্বত, যা নির্দিষ্ট, যা ধ্রুব। সব ক্ষেত্রেই সে তা চায়। বিজ্ঞানে একদিন অণুকে ধ্রুব জেনেছিল। তারপর এল পরমাণু। আজ তাকে ছাড়িয়ে আরো অন্য কিছু। বিজ্ঞান একটা সূত্রকে আবিষ্কার করার প্রয়াস পেয়েছে সব ক্ষেত্রে। তাকে ধ্রুব মেনে অন্যান্য সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ খুঁজেছে। এক কথায়, সে এই বিশ্বচরাচরের মধ্যে একটা নিয়মকে খুঁজেছে, যাকে সে বলতে পারে অচল, ধ্রুব, শাশ্বত। তেমনি সমাজেও সে একটা নিয়ম বানাতে চেয়েছে, সে আইনব্যব্যস্থা এনেছে, যাকে সে বলছে ধ্রুব। অবশ্যই এই ধ্রুবও অন্যান্য ধ্রুবগুলোর ন্যায় সময়ের সাথে, অভিজ্ঞতার সাথে পরিবর্তনশীল। 
ঠিক তেমনই একটা মানবিক বোধ হল - ধর্ম। তার অভিব্যক্তি ঘটেছে বারবার। জড়ের উপাসনা থেকে ক্রমশ চেতনার জাগরণকে বলা হল ধর্ম। সারা বিশ্বে ভারতের মত আর কোথাও এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ ধর্ম নিয়ে বোধহয় আর কোনো ভূখণ্ডে হয় নি। ফলস্বরূপ সারা বিশ্ব পেয়েছে অত্যন্ত গভীর ও অত্যন্ত উন্নত একটা দর্শন। সারা বিশ্বে তা স্বীকৃত, আদৃত হয়েছে নানা গুণী-জ্ঞানী মানুষের দ্বারা, এ বলা বাহুল্য আজ। 'হিন্দু' নামটা সে দর্শনের একটা অত্যন্ত দুর্বল পরিভাষা। কারণ তাতে পাড়ার শেতলা পূজো থেকে রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-গান্ধী-অরবিন্দ সব একধারায় নির্দিষ্ট হয়। এদের মধ্যে সবচাইতে করুণ অবস্থা বোধ করি আজ বিবেকানন্দের। তাঁকে সম্পূর্ণ না পড়ে বিচ্ছিন্ন কয়েকটা উদ্ধৃতিতে যে কি ভীষণ দূষণ চলছে রাজনৈতিক মহলে তা কহতব্য নয়। কষ্টই হয়। কোনোদিনই আমরা আকর গ্রন্থে না গিয়ে, সব কিছুকেই ভাসাভাসা জেনে, দল পাকিয়ে, অজ্ঞানতার গর্ব করে কূপের মধ্যে জীবন কাটানোকে গৌরবের বলে জেনেছি। আজও সে ধারা অব্যহত। শিকার হচ্ছে আমাদের দেশের গৌরবের সম্পদগুলো। এ নিতান্তই দুর্ভাগ্য। 
মত আর ধর্ম – এ দুটোকে এক করে দেখা মানে গঙ্গা আর নদীকে সমার্থক বলে জানা। দ্বন্দ্বটা ধর্মের সাথে ধর্মের না, মতের সাথে মতের। এটা স্পষ্ট বুঝতে হবে। আমরা যখন উঁচু ক্লাসে পড়ছি তখন স্কুল থেকে নির্দিষ্ট বইয়ের নাম বলে দেওয়া হত না। যে যার পছন্দমত লেখক বেছে নিত, কিন্তু বিষয়টা একই থাকত। পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, অঙ্ক, রসায়ন ইত্যাদিতে সবক্ষেত্রেই তাই করেছি। বন্ধুদের সাথে মতান্তর হয়েছে, আমার মতে এটা শ্রেষ্ঠ বই তো ওর মতে অমুকটা। সৌভাগ্য হাতাহাতি হয়নি। কারণ ইন্ধন জোগানোর পর্যাপ্ত লোক ছিল না। ধর্মের ক্ষেত্রে তা আছে। আরো দুর্ভাগ্য যখন সমাজের স্বীকৃত বুদ্ধিজীবিরাও সেই শব্দের ফারাকটুকু না বুঝে সস্তা প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতিত্বের খেলায় নেমে পড়েন। পদের সাথে যে দায় বর্তায় তাকে অস্বীকার করার মধ্যে একটা অপরিণত, উদ্ধত মানসিকতার পরিচয়ই আসে, তার বেশি কিছু নয়। কিছু জলঘোলা হয়, রক্তারক্তি হয়, আবার সব শান্ত হয়। সেই মানুষগুলোর ভিতরকার পরিচয়টাও উন্মোচিত হয় আর ইতিহাসের কালো পাতায় তারা মুখ গুঁজে স্থবির হয়। 
তবে ধর্মটা কি? সে চিরকালীন - সত্য প্রেম করুণা। পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থ মানুষকে অসৎ, নিষ্ঠুর হতে শেখায় না। প্রতিটা সম্প্রদায় থেকে কোনো না কোনো মহাত্মা ইতিহাসের পাতা উজ্বল করে আছেন। আর তাতেই প্রমাণ হয় প্রতিটা মতের মধ্যে কিছু না কিছু সারবস্তু আছে যা সেই মহাত্মাদের জন্ম দিয়েছে। এ বোধ আমার অন্তত জন্মেছে বিবেকানন্দ পড়ে। একবার ভেলোর হাসপাতালে খ্রীষ্টকে নিয়ে একটা আলোচনায় যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল; সেখানে ফাদার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, খ্রীষ্টকে নিয়ে এমন গভীর আগ্রহ আর বোধ জন্মালো কিভাবে? গর্বের সাথে বলেছিলাম, বিবেকানন্দ-মহাত্মা-রবীন্দ্রনাথ পড়ে। এঁরা তো গ্রহন করতেই শিখিয়েছিলেন। এমনকি 'পরধর্মসহিষ্ণুতা' শব্দটাতেও স্বামীজির ঘোরতর আপত্তি ছিল, যেন ওর মধ্যেও 'আমি তোমার থেকে উন্নত' এমন একটা ভাব আছে। বলেছিলেন সবার কাছ থেকে শেখার কথা, নেওয়ার কথা। তবে আজ এ বিচ্ছিন্নতার কথা অন্তত আমাদের কে শেখাচ্ছে? তারা কারা? কোন ধর্মগ্রন্থের দোহাই তারা দিচ্ছে? কোন ধর্মে লেখা আছে যে একটা বইয়ের কিছু শব্দই ধ্রুব? কোত্থাও লেখা নেই। ওগুলো সূত্র। মানবহৃদয় তার পরীক্ষাগার। শুধু সূত্র মুখস্থ করে গেলাম আর কোনোদিন ল্যাবে ঢুকলাম না, কেমন করে শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে? হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মেশালে জল হয় - এটা ধর্ম। কিন্তু সেই মেশানোর পদ্ধতিটা তো নানান হতেই পারে! সেই তো মত। তুমি তোমার মত বানাও, আমি আমার মত বানাই। শেষে যখন দেখব দুজনেরই সেই শীতল জল উৎপন্ন হয়েছে তখন হাসতে হাসতে ল্যাব থেকে গলা জড়াজড়ি করে বেরিয়ে আসব। কিন্তু শুধু সূত্র মুখস্থ করে গেলে তাতে মাথা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। ল্যাবে ঢুকতেই হবে। আর ল্যাবে ঢুকলে নতুন সূত্রও আবিষ্কার করা যেতে পারে, "এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা"। 
এবার উপসংহার টানি। এতক্ষণ যা বললাম তা তত্ত্ব। অনেকে বলবেন, তুমি এতক্ষণ যা বকে গেলে সে সব কথা আমরা আগে বহুবার পড়েছি। কিন্তু দাদা, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। বেশ, তত্ত্বকথা থাক। কথামৃত, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ইত্যাদি সব বিশ্ববিজয়ী মহাপুরুষেরাও থাক। এদের পড়ে বোঝা শক্ত শুধু না, এদের জীবনের দিকে তাকিয়ে অনেকাংশেই শুধু ‘হিন্দু’ বলে তকমা আঁটাটাও মুশকিল না। কারণ রামকৃষ্ণের কথাতে ‘সর্বধর্ম সমন্বয়ের’ কথা থাকলেও বাস্তব জীবনে হিন্দুমতের অনুশীলনই প্রধান।
সব তত্ত্ব, ভাবের কথা থাক। 'সেক্যুলারিজ্‌ম' তো আরো না। তার দাপটও অন্যান্য গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে বহু ক্ষেত্রে কম কিছু না। সে নিজেই একটা তথাকথিত আধুনিক ধর্ম বলা যায়। সেও থাক। 
আজ কাগজে দেখলাম আসন্ন 'উরুস' পর্বের জন্যে বিশেষ ট্রেন চলার বিজ্ঞাপন। মনটা ঠেক খেল। পশ্চিমের দিকে একটা একদা অখ্যাত গ্রামের কথা মনে পড়ল। এক কপর্দকশূন্য ফকির সেই গ্রামে যুবা বয়সে আচমকা এসে পড়ে। তার অসামান্য ব্যক্তিত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে সেই গ্রামের সরল বেশিরভাগ অশিক্ষিত মানুষজন তাকে আপন করে নেয়। ক্রমশ তার কথা দূর দূরান্তের গ্রামের লোকজন জানতে পারে। ভিড় বাড়ে। নির্ভরতা বাড়ে, ভক্তি বাড়ে, উৎপাতও বাড়ে। ফকির কাউকেই বিমুখ করে না। একটা ছেঁড়া আলখাল্লা পরে, মাথায় একটা ফেট্টি বেঁধে সারা গ্রাম ভিক্ষা চেয়ে বেড়ায়। সে ভিক্ষা চাওয়ারও কি কৌশল, একটা টিনের পাত্রে ঝোল আর ঝোলার মধ্যে রুটি নিয়ে তার ডেরায় ফিরত। সে রুটি থেকে কিছু গরীব মানুষেরা নিয়ে যেত, কিছু কুকুর খেয়ে যেত, অবশিষ্ট সে নিজে খেত। একবার গ্রামে উরুস আর রামনবমী একসাথে পড়ল। দু’পক্ষই মিছিল বার করবে। করলও। রাস্তায় প্রায় মারামারি বাধে আর কি! সে ফকির ক্রুদ্ধ হল। বলল, "ওরে মূর্খের দল, রাম-রহিমের মধ্যে পার্থক্য কে করল! নিজের মঙ্গলের পথ চিন্তা করো।" না উপদেশের কথা না, সে অনেক আছে, জীবনের কথা। তার জন্য বানানো রুটি যদি কুকুরের প্রতি মায়াবশত কেউ খাইয়ে দিয়েছে এমন হত, তবে সে ফকির খুশি হয়ে যেত। নিজেকে অন্যের বিষ্ঠার একটা কীটের সাথেও তুলনা করতে সংকোচ বোধ করত। থাকত মসজিদে, তাকে বলত দ্বারকামাঈ। সামনে তুলসীগাছ লাগিয়ে জল দিত দু’বেলা। হজ করা হাজিকে বলত অহংকার না করতে, আবার নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণকেও ভর্ৎসনা করত ব্রাহ্মণত্বের অহংকার দেখালে। একবার এক গরীব কুষ্ঠ রুগী কিছু ফল নিয়ে আসে সে মসজিদে। সে ফকির সেটা উপস্থিত ভক্তের মধ্যে ভাগ করে দেয়। একজন একটু উন্নাসিক মহিলা সেটা লুকিয়ে ফেলে দেয়, ঘৃণায়। ফকিরের নজর এড়ায় না। সে আবার সেই কুষ্ঠাক্রান্ত মানুষটাকে ডাকে, ওর হাতে ফল দিতে বলে, আর বলে আমার সামনেই খাও। রোগকে ঘৃণা করো, রুগীকে না। আরেকবার এক বোর্খাবৃত সুন্দরী মহিলার দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাচ্ছিল ফকিরের পাশে বসা এক ব্যক্তি। সে মহিলা চলে গেলে ফকির তাকে বলে, “সামনের দরজা খোলা থাকতে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করো কেন? সুন্দরকে দেখো, মনের মধ্যে পাপ এনো না।”
সে ফকিরের গল্প বলতে শুরু করলে শেষ হওয়ার নয়। থাক। তার প্রধান শিক্ষা দুটোই। এক) সবার মালিক একজনই, দুই) মানব জীবনের সাধনা দুটোই - শ্রদ্ধা আর ধৈর্য্য। এইভাবে সারাটা জীবন একই সাথে দুটো ধর্মের মধ্যে সহাবস্থানের উদাহরণ অত্যন্ত বাস্তব কঠোর জীবনে ভারতে আরো আছে কি না আমার অন্তত জানা নেই। লালন ইত্যাদি বাউলেরা যে পথ ভাবের মধ্যে, গানের মধ্যে খুঁজেছিলেন এই ফকির সে পথ তীক্ষ্ণ বোধ, বিশ্লেষণ আর বাস্তব মাটিতে জীবনের চর্যায় দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। কবীরের সাথে তাঁর কোথাও একটা মিল আছে বলেই হয় তো বলতেন, “কবীর আমার বাপ!” 
এই জীবনটা আজ আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। যখন আমি কর্মক্ষেত্রে ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে কাজে নামি, আমার ছাত্রছাত্রীদের নানান প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়াই, তখন মাথায় ফেট্টি বাঁধা সেই সরল সহজ মুখটা মনে পড়ে। 
হ্যাঁ আমি সাঁইয়ের কথাই বলছি। গ্রামটার নাম শিরডী। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, সেখানে অনেক টাকার মন্দির ইত্যাদি। আমি বলি, আমি বহিরঙ্গের তর্কে যাব না। জীবনটার কথা বললাম, পরেরটা তো আমরা করেছি, সে কথা থাক। 
আজ এই ভীষণ দুর্দিনে সেই ফকিরকে ভীষণ প্রয়োজন। যাকে ভাবতে কোনো দেব-দেবী, মন্দির-মসজিদ ভাবতে হয় না। সরল প্রাণে ভাবতে হয়, জগতে ‘এক’ বই দুই নেই। পাওয়ার পথ শ্রদ্ধা আর ধৈর্য্যের সাধন। এ দুটো চিরকালীন মানবসম্পদ, কোনো সম্প্রদায়ের না।