বড় অসময়ে চলে যাওয়ার ধুম উঠেছে। কেউ নিজেই দরজা ভেজিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ নাচতে, নাচতে, ব্যায়াম করতে করতে, হাঁটতে, বসতে চলে যাচ্ছে। রিলে ভিডিও দেখা যাচ্ছে। লক্ষ লাইক পড়ছে। লোকে বলছে, ইস.. এই রে.. রিপ... কি যে হচ্ছে!
যদিও কিভাবে কিভাবে যেন আমিও জানি কি হচ্ছে। মরতে তো আর কারোর অনুমতি নিতে হয় না। ধুম করে মরে গেলেই হল। আমি ইচ্ছা করে মরে যাওয়ার কথা বলছি। জীবনটাকে কুড়ি ওভারে সাল্টে দেব ভাবতে চাইছি কি? টেস্ট আর ভাল্লাগছে না। যত্তাড়াতাড়ি পাওনা-গণ্ডা মিটে যায় তত্তাড়াতাড়ি তল্পিতল্পা গুটিয় পালাই আরকি। আকাশে একটু সিঁদুরে মেঘ দেখলাম কি "চল্লাম ভাই" বলে টাটা হয়ে যাচ্ছি।
খুব মুশকিল। বাচ্চাবুড়োকচিকাঁচা সব্বাই তেড়ে মরতে লেগেছে। ইচ্ছা করে। ওদিকে আবার হঠাৎ হার্টফেল হওয়াটাকে কেউ বলছে কোভিডের জন্য, কেউ বলছে ভ্যাক্সিনের অ্যাকশান। সেগুলো নিয়ে ভাবতে পারি না। অত জ্ঞান নেই। হলে হবে। অপশান নেই।
বেঁচে থাকাটার কোনো মানে তো একটা চাই। অবশ্যই চাই। কিন্তু সেটা যুক্তির কম্ম নয়। সেটা বিশ্বাসের কম্ম। ইচ্ছা বিশ্বাস থেকে জন্মায়। ইচ্ছা তো একটা ফিলিংস। একটা অনুভব। একটা পজিটিভ অনুভব। এই যে আমি আছি, এই যে আমি কাজ করছি এর একটা মানে আছে। এমন একটা বিশ্বাস না জন্মালে মানুষ বাঁচে কি করে?
একটা লোক নৌকা চড়ল। কিছুটা এগোনোর পর বুঝল নৌকায় ফুটো। চুকচুক করে জল ঢুকছে। সে এদিকে সাঁতারও জানে না। এইবার? বলি এই চুকচুকে জলে তো আর সেতারের সুর কানে আসবে না! কি করবে? মাঝনদীতে বসে প্রাণপণে দাঁড় বাইবে ওপারে যাবে বলে। যত জোর টানে তীর তত দূর গিয়ে চোখে ঠেকে। তবে? এবার সে যায় কই? ঈশ্বর চিলের মত ছোঁ করে নিয়ে যাবে? নাকি পাশের নৌকায় জায়গা হবে? নাকি অলৌকিকভাবে সাঁতার শিখে যাবে?
কিস্যু হবে না। নৌকা ডুববে। কিন্তু ডোবার পর বুঝবে সে ডুবছে না। কিন্তু নিজেকে ডোবানোর ক্ষমতা তার আছে, এটা বেশ বুঝতে পারছে। ভেসে আছে। দু-এক পা হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতারের মত কিছু একটা করছেও। সে বুঝতে পারছে ভেসে থাকাটা তার কপালে আছে। কিন্তু সাঁতার কাটার ভীষণ ক্ষমতা তার নেই। জলের স্রোতে ভেসে থাকতে হবে। কখনও অনুকূল, কখনও প্রতিকূল। চাদ্দিকে কাতারে কাতারে নৌকা। কারোর আজ ডুববে, কারোর কাল। তীর বলে কিছু নেই। কেউ মিনিটে কুড়ি বার হাত পা ছুঁড়তে পারে, কেউ একবার। জলের মধ্যে তুমুল হইহট্টগোল। সবাই হাত পা ছুঁড়ে সাঁতর কাটছে। সবাই ভাবছে আমি বুঝি পিছিয়ে গেলাম। কিন্তু কোথায় যে যাচ্ছে সবাই কেউ জানে না। আসলে সম্মিলিতভাবে কেউ যে কোথাও যাচ্ছি না এটা তো শুরুতে বোঝা যায় না। সবাই ভাবে আমি ক এর থেকে আগে, খ এর থেকে পিছিয়ে, গ ওই তো দেখা যাচ্ছে… ঘ ওই যে ডুবে যাচ্ছে…
এই চলছে। আদিকাল থেকেই চলছে। যদি বলো মানুষের গড় আয়ু কত, টক করে উত্তর দিয়ে দেবে বই। যদি বলো ক এর আয়ু কদ্দিন? কোনো উত্তর নেই। যদি বলো মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কি? কোনো সঠিক স্থির উত্তর নেই। কিন্তু যদি বলো ক এর জীবনের উদ্দেশ্য কি? আছে। ওই জলে ভাসতে ভাসতে, যতটা সাঁতারের ক্ষমতা সেই অনুপাতে কিছু একটা আঁকিবুঁকি কাটার চেষ্টা আরকি! কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে একটা!
যীশুর জন্মদিন এসে গেল। কত মানুষ কত ভাবে জানল মানুষটা জন্মালো কেন। কারণ অনেক। যাতে আমি কেক কিনতে পারি, পিকনিক করতে পারি তাই। পাদ্রী বললেন, উঁহু, তাঁর রক্তে বিশ্বাস করলে তুমি উদ্ধার পাবে তাই। দার্শনিক বলল, ভালোবাসো, এই কথাটাকে জীবনে পালন করবে তাই। কারোর কথাতেই কিছু আসে যায় না। তবে হ্যাঁ যীশুর কথাতে সেই মৃত্যুর কথাটা আসে। কেমন একটা জাঁদরেল মৃত্যু। বড়দিন তো আজ।
এমন মৃত্যু বড়দিনের সঙ্গে লেগে গেল কেন? কারণ মনে হয় যীশু জীবনকে বড় আদর করে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন। মানুষকে জ্ঞানের কথা বলে কান পাকিয়ে হদ্দ করেননি। মানুষের রাগ, হতাশা, অভিমান, দুঃখের উপর হাত রেখে বলেছিলেন, এ সবের একটা মানে আছে। বিশ্বাস করো। জীবন আকস্মিক নয় গো। ভালোবাসো, বুকের মধ্যে বীজ অঙ্কুরিত হবে। সেই বীজ থেকে বিশ্বাসের গাছ হবে। সেই গাছের শিকড় জীবনকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখবে। হড়পা বান, কি ভূমিকম্প এসে পড়লেও ধ্বসে যাবে না। একটু বিশ্বাস করো।
জীবনের উপর বিশ্বাস হারিও না। প্রচুর দুঃখ, হতাশার মধ্যে যুক্তি দিয়ে পালাবার কোনো রাস্তা পাবে না। কিছু বুঝবে না। বিশ্বাস করো, জীবনকে জীবনের মত মেলে ধরো। ভালোবাসো বীজকে। গাছকে ভালোবাসাই হবে তবে। ভালোবাসার বীজে ভালোবাসাই জন্মায়। মানে জীবনের উপর বিশ্বাস। নইলে এক চোখের বদলে এক চোখ নিলে জগত একদিন অন্ধ হয়ে যাবে। চোখ দেখে না, দেখে বিশ্বাস।
এইটুকুই বলছি, জগতকে ভালোবাসতে হবে না। বীজকে ভালোবাসলেই হবে। বীজ অঙ্কুরিত হলে দেখো ধড়াস করে আওয়াজ হয় না। বাদ্যি কাঁসর বাজে না। নিঃশব্দে অঙ্কুরিত হয়, নীরব ভালোবাসায় কারোর। তারপর তো গাছটাছ হয় কত কি হয়…. আসল কথাটা কিন্তু মনে রেখো। বিশ্বাস। জীবনের উপর বিশ্বাস।