মনোযোগের অভাব- এটা নতুন কোনো সমস্যা না। কিন্তু একটা অন্য কথা বলতে চেষ্টা করছি। মনোযোগ ছাত্র অবস্থায় কি বড় অবস্থায় দুটো কারণে আসতে দেখেছি। এক শাস্তির ভয়ে, যেটার সংখ্যা বেশি, আর এক বোধের উদয়ে। যদি বলি সিগারেট খাওয়া উচিৎ না, তবে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন আমি খুব একটা ন্যায্য কথাই বলেছি। কিন্তু কাজে করতে কি পরেরদিনই শুরু করে দেবেন? কক্ষণো না!
দু'প্রকার লোক তা করে থাকতে পারেন। এক, যিনি কাউকে দেখেছেন কোনো রোগে আক্রান্ত হতে বা নিজে অসুস্থ হয়েছেন। কিম্বা যিনি খানিকটা পড়াশোনা করেই হোক বা যে কোনো কারণেই হোক কিছু একটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন সিগারেট খাওয়ার হানিকর দিকটার ব্যাপারে।
সৎ জীবন যাপনের বেলাতেও এর ব্যতিক্রম হয় কি? না হয় না। বেশীর ভাগই মানুষই সৎ জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। তাই এত পুলিশ, কোর্ট, আইন লাগে লোকের মধ্যে সৎ ভাবটাকে স্থায়ীভাবে বজায় রাখার জন্য। শাস্তির ভয়, অপমানিত হওয়ার ভয়, আর্থিক ক্ষতির ভয় ইত্যাদি নানাবিধ ভয় যখন কোনো মানুষের তথা দেশের নৈতিক জীবন যাপনের মুল অনুপ্রেরণা হয় তখন ভয় বা আইন একটু শিথিল হলেই দুর্নীতির মহামারী শুরু হওয়ার উপক্রম হয়। 'অপরাধ করে যদি শাস্তি এড়ানো যায় তা হলে অপরাধ করব না কেন?' এই 'কেন'-র উত্তর কোনো যুক্তি দিতে পারে বলে আমার মনে হয় না। কারণ নৈতিক স্বচ্ছ থাকার তাগিদটা যদি ব্যক্তিগত না হয় তবে তাকে সার্বজনীন কি করে করা সম্ভব? আবার এর অন্যদিকটাও আছে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে নৈতিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য বাইরে থেকে অনুপ্রেরণা লাগে না, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব দেশে, সব কালেই কম। বেশির ভাগ মানুষেরই এর জন্য একটা উৎসাহ, অনুপ্রেরণা বাইরে থেকে প্রয়োজন হয়। যে সমাজ নৈতিকভাবে সুস্থ হওয়ার জন্য যতটা সুযোগ বা পরিবেশ তাকে দিতে পারে সে সমাজ তত বেশি স্বচ্ছ নরনারী জন্ম দেওয়ার অধিকারী হয়। সেই স্থান দেওয়ার প্রধান শর্তই হল তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। যে মানুষ সত্যটাকে প্রধান উপজীব্য করে চলবেন বা সহজ সত্যটাকে সর্বজনসম্মুখে আনতে চাইবেন, তাঁর ততোধিক শত্রুসংখ্যা বাড়বে এ বলা বাহুল্য। কিন্তু তবু সে লড়তে পারে যদি রাজশক্তি তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাতে শাসকদলের সাথে শাষিতের একটা স্বচ্ছ সম্পর্ক গড়ে ওঠার সূত্র তৈরী হয়। কারণ সত্যের একটি অসাধারণত্ব হল, সে স্বপ্রকাশ। সত্যটাকে একজন কৃষাণ মজুর যেভাবে সহজে গ্রহণ করতে পারেন একজন উচ্চ-শিক্ষিত মানুষও সেভাবেই পারেন। যেমনভাবে ভারতের গরীব অশিক্ষিত মানুষের সাথে উচ্চশিক্ষিত মানুষও মহাত্মাকে নিজের লোক বলে মনে করতে পেরেছিলেন। সেটা পেরেছিলেন কি মহাত্মার বাক্যের জোরে? যুক্তির জোরে? না কৌশলে মুগ্ধ হয়ে? না এর কোনোটাই না। মানুষ তাঁকে চিনেছিল, নিজের করে জেনেছিল তাঁর চরিত্রের স্বচ্ছতার জোরে, সত্যের জোরে।
তাই বলছিলাম, যে রাজশক্তি সাধারণ মানুষের এই ন্যায়ের পথে থাকাটাকে সুরক্ষিত করতে না পারেন সে রাজশক্তি সেই দেশের পক্ষে কখনোই আত্যন্তিক মঙ্গলকর হতে পারে না। কোনো দেশের জনস্বার্থ রক্ষার প্রধান ভিতটাই হল তাকে সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। শুধু বাক্যের আস্ফালন, ক্ষমতার প্রদর্শন কালের গতিতে ক্রমশ দুর্বল হতে হতে, দেশের মেরুদন্ডকে ক্ষয় করতে করতে একটা বড়রকম দুঃসময়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যত তাড়াতাড়ি আমরা এটাকে ব্যক্তিগত জীবনে কি সমাজ জীবনে উপলব্ধি করি ততই মঙ্গল।