Skip to main content
নিত্য নতুন তথ্য, তত্ত্ব আমাদের রোজ শুনতে হচ্ছে, জানতে হচ্ছে কোভিড নিয়ে। যেটা মাঝে মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। মনে হচ্ছে আসল কথাটা কি তবে?
       এই 'আসল কথাটা' মানে ঠিক কি জানতে চাইছি? ওষুধ, চিকিৎসার নানা খুঁটিনাটি, নানা বিধিনিষেধ ইত্যাদি সমস্ত নিয়ে এত ধোঁয়াশা রোজ তৈরি হচ্ছে কেন? এই একটু আলোর মুখ দেখলেই আবার কোথা থেকে সংশয়ের কালো মেঘ সব কিছুকে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে?
       একটা কথা আমাকে বুঝতে হবে। একটা হল তথ্য, আর আরেকটা হল জ্ঞান। একটি অভিধান হল তথ্যভাণ্ডারের একটি আদর্শ উদাহরণ, আর জ্ঞান হল সেই শব্দভাণ্ডারকে ব্যবহার করতে পারা, অনুভব করতে পারা, বোধগম্য করে তোলা।
       জ্ঞান অনেক তথ্যের উপর নির্ভর করে। তথ্য কি? সে পরিসংখ্যান হতে পারে, নানা পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল হতে পারে, পূর্বতন কোনো ঘটনার ফলাফল হতে পারে। কোভিডের ক্ষেত্রে এর কোনোটার ভাণ্ডারই আমাদের কাছে পর্যাপ্ত নয়। ফলে নানা তথ্যের চমক দেওয়া সংবাদমাধ্যমের ব্যবসার দিকে তাকিয়ে নানা তিলকে তাল আর তালকে তিল করার খেলা, তার উপর নানা রাজনৈতিক লাভালাভের হিসাবের চাবি ডানদিক কিম্বা বাঁদিক ঘোরানোর খেলা – মোটকথা আমরা সত্য হতে বহুদূর।
       এখন প্রশ্ন হতে পারে, এই 'সত্য' কথাটা তথ্য না জ্ঞান? দুই সত্য। একটা ফ্যাক্ট, আরেকটা নলেজ। নলেজ একটা থিওরি। যে থিওরিটা ভুলও হতে পারে, তাকে আবার শুধরে নেওয়াও যেতে পারে। আমরা নানা ঘটনায় মনে মনে নানা থিওরি দাঁড় করাতে থাকি, আবার বাস্তবতার সাপেক্ষে তাকে বদলে নিতেও পারি। যেমন সত্যজিৎ রায়ের 'মহাপুরুষ' সিনেমার সেই দৃশ্যটা ভাবুন, যেখানে ট্রেনের জানলা দিয়ে তাকিয়ে গুরু হুঙ্কার দিচ্ছেন, ওঠ... ওঠ...। অমনি খানিকবাদে সূর্য উঠে গেল। ভক্তের মনে অমনি একটা বিশ্বাস জন্মে গেল, অর্থাৎ একটা থিওরি জন্মে গেল যে যেই না গুরুদেব হুঙ্কার দেবেন অমনি সূর্য উঠবে। এবার ধরুন ঘটনাচক্রে একদিন গুরুদেব সকালে উঠলেন না, তাও সূর্য উঠে গেল। তখন বুদ্ধিমান ভক্ত হলে বুঝে যেত তার আগের তত্ত্বটা ভুল, অর্থাৎ কিনা সূর্যটা ওঠার সাথে গুরুদেবের হুঙ্কারের কোনো যোগাযোগ নেই। কিম্বা আরেকটা উদাহরণ নেওয়া যাক, একটা বাচ্চা হয় তো ভাবে তাদের বাড়ীর উঠানের থেকে মোরগটা ডাকলেই সূর্যটা ওঠে। একদিন মোরগটা ডাকল না অথচ সূর্যটা উঠে গেল, তখন অবশ্যই সে ভেবে নেবে যে তার আগের তত্ত্বটা ভুল ছিল। সে তখন নতুন তত্ত্বে বিশ্বাস করবে যে সূর্য ওঠার সাথে মোরগের ডাকের কোনো সম্পর্ক নেই।
       কিন্তু ভারতীয় মানসিকতায় আমাদের জ্ঞান আর বিশ্বাসের মধ্যে – 'জাস্টিফায়েড' কথাটার খুব একটা গুরুত্ব নেই। শ্রদ্ধা সেই জায়গাটা খেয়ে নিয়ে বসে আছে। শ্রদ্ধার অনেক ভালো গুণ আছে মানি, কিন্তু তার অবগুণটুকুও কম নয় সংসারে। সত্যের একটা তত্ত্ব আছে, JTB --- Justified True Belief, অর্থাৎ সঙ্গত বিশ্বাসযুক্ত জ্ঞানই সত্য। ভারতীয় মাটিতে এ তত্ত্বটার বড় অভাব। তার তত্ত্বদাতার প্রতি অন্ধ শ্রদ্ধার ঝোঁক যতটা বেশি, ততটা তাকে বাজিয়ে নেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করা হয় না। হয় তো রামকৃষ্ণদেবই প্রথম যিনি বাজিয়ে নেওয়াতে বিশ্বাস করতেন। যদিও সে প্রথা আর রইল না। সেদিন দেখলাম সূর্যগ্রহণের ক্ষতিকারক কুসংস্কারকে তাঁর আদর্শ অনুগামী প্রতিষ্ঠান সত্য বলে ধরে নিচ্ছেন। সে কথা থাক। প্রতিষ্ঠান তো অধিষ্ঠানে দৃঢ়সংকল্প হবেই, চলার কথায় তো ভিত নড়বেই।
       কথাটা হচ্ছে সঙ্গত বিশ্বাসযুক্ত জ্ঞানের প্রতি আমাদের কোনোদিনই তেমন ঝোঁক ছিল না, এখনও নেই। আমাদের সেই ঝোঁক না থাকাকে ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ নামে দেগে প্রশংসার তকমা এঁটে, গৌরবের ভূষণ পরিয়ে সমাজে চলমান রেখে দিয়েছি। তাই আমাদের এই দুর্যোগের দিনে, প্রবল সংকটের দিনে কোনো একটি বিশেষ মন্দিরের লক্ষকোটি টাকা ব্যয় করে শিলান্যাস করাকে অসঙ্গত বোধ হয় না। আমরা এখন একটা চটজলদি তত্ত্ব খুঁজছি। একটা শর্টকাট। একটা ম্যাজিক। নানা তথ্যাবলী, পরীক্ষানিরীক্ষামূলক পথের দিকে তাকিয়ে থাকার অভ্যাস আমাদের কোনোকালেই নেই। তাই এই যুগেও ভূয়ো বিজ্ঞান-মিস্টিক-দর্শন -এর ককটেল গুরুর অভাব হয় না। যিনি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে সাপের বিষ খেয়ে হজম করে দেন, সাথে মানবসেবা, পরাজ্ঞানের বহুমূল্য কোর্সের একটা ধোঁয়াশায় পাবলিক ডিলিং করে চলেন। অন্ধকার আর আলো – এই দুইতেই মানুষ নিজের অবস্থান নিয়ে স্পষ্ট। কিন্তু তাতে তো মুশকিল, তাই কুয়াশা তৈরি করো। কুয়াশায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়। একের লজিক অন্যের ঘাড়ে চাপায়। “ওরা কি লোকসেবা করে না”? “উনি কি এত এত মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি”? “উনি কি মশা ফাউণ্ডেশান নিয়ে গুগুল টকে বক্তৃতা রাখেননি?” --- এই সব কথাগুলো সত্য, কিন্তু খণ্ডিত ঘটনা হিসাবে সত্য, যুক্তি হিসাবে ফ্যালাসি। চিন্তার স্বচ্ছতার চাইতে কপট ম্যাজিক মহত্বের ধোঁয়াশা অনেক পাব্লিককে কাছে এনে দেয়। সক্রেটিস বলতেন, আমায় লোকে পছন্দ করে না আমার ফ্র্যাঙ্কনেসের জন্য। কবীর বলতেন, আশ্চর্য সব মানুষ, সরল সত্য কথা বলো তো তারা মারতে আসে, আর মিষ্টি মিথ্যা কথা বলো তো তোমায় মাথায় চড়িয়ে রাখে। ঘটনাচক্রে এই দুই জনেরই প্রাণ গিয়েছিল একই কারণে – সত্যকথা সহজ করে বলার অপরাধে। তাই এই আধুনিক যুগের মিস্টিক গুরুরা, যারা পরকালের সাথে ইহকালের সব তত্ত্ব জানেন বলে দাবি করে বেড়ান, তারাই বিশ্বসৃষ্টির আদিকালে উৎপন্ন এই জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী ভাইরাসের নাশের কৌশল জানতে বিদেশি গবেষণাগারের দিকে সশিষ্য তাকিয়ে থাকেন। ভক্ত নিজেকে ভাবায় উনি চাইলেই জানতে পারেন, জানতে চান না এ ওনার লীলা। জানলে পাছে অহংকার হয়, তাই লোকশিক্ষার জন্য এমন বিনয়। আসলে আলো নিভাতে তো কষ্ট নেই। কষ্ট আলো জ্বালতেই। চোখ বন্ধ করতে তো অসুবিধা নেই। চোখ বন্ধ করলেই নিজের মধ্যে নিজের রাজত্ব। চোখ খুললেই তো নানা বিরোধময় জগৎ। তার মধ্যে সমন্বয় করার দায় কে নেবে? তার চাইতে চোখ বন্ধ থাক।
       যে দেশে এখনও কন্যাভ্রূণ হত্যা ঠেকাতে টাটকা কালি দিয়ে লেখা নানা বিজ্ঞাপন দেওয়ালে দেওয়ালে, সেই দেশে হঠাৎ করে সব্বাই মিলে ভয়ংকর যুক্তিপরায়ণ হয়ে, মানবিক হয়ে এই দুর্যোগ ঠেকাবে সে আশা করা সোনার পাথরবাটি আশা করার মত। তবে আইন, জরিমানা, ত্রাস – আমরা ভালো বুঝি, সেই পথেই আমাদের শিক্ষাও হয়, পূর্ণমাত্রায় না হলেও আংশিক। যেমন সদ্য করোনা ত্রাসে বিডিওকে ঢুকতে না দেওয়ার অপরাধে বেশ কয়েকদিন হাজতবাসে রাজ্যবাসীকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, নিজের সীমার মধ্যে থাকো। এ পথ খুব উন্নত সভ্যতার উদাহরণ না হলেও, এই পথটা ঠিক অন্তত আজকের পরিস্থিতিতে।
       শুরুর কথায় আবার ফেরা যাক। আশু কোনো রাজপথ আমাদের বিদ্যার নাগালে নেই এইটা আপাতত মেনে নিতে হবে। নানা পরীক্ষানিরীক্ষা হবে, শুধু গবেষণাগারেই নয়, নানা সামাজিক বিধিনিষেধেও, সেটাও বুঝে নিতে হবে। নিজের চোখকান খোলা রাখতে হবে, মিষ্টি মিথ্যা আশ্বাসের দিকে কান পেতে নয় অবশ্যই, যেটা সঙ্গত বিশ্বাসযুক্ত জ্ঞান তার দিকে তাকিয়েই। নানা যুক্তি বা অপযুক্তি অবশেষে সবটাই কল্পনা এখন। মনে রাখতে হবে যুক্তি কিন্তু প্রমাণ নয়। এত এত দার্শনিক, এত এত মিস্টিক মহাশয়েরা যুগ যুগ ধরে হাজার গণ্ডা বিচার করেও একমত হতে পারলেন না মানুষের আত্মা আছে কি নেই। অগত্যা তারা কোভিডের সত্যাসত্য জানিয়ে দেবেন এমন আশা করা বৃথা। ওনাদের ওইসব কাল্পনিক অনুমানগত লজিকের ভুলভুলাইয়া থেকে বেরিয়ে আসাই মঙ্গল। একটা ছোটো উদাহরণ দিই। যদি বলো স্বচ্ছ কাঁচ কি? বলা হয় যার ভিতর দিয়ে আলো আসে। আবার যদি বলো কার ভিতর দিয়ে আলো আসে, তবে কথা হল স্বচ্ছ কাঁচের ভিতর দিয়ে। এই সব গোলানো কথা থাক। কাঁচের ভিতর দিয়ে আলো কি করে আসে বুঝতে একজন পদার্থ বিজ্ঞানীর কাছে যাও, বুঝিয়ে দেবেন। অর্থাৎ জ্ঞান আসুক, অনুমান আর নানা মনোরম ধাঁধারা বিশ্রাম করুক। জল্পনারা বিদেয় হোক। মনটা আলোকিত হোক। একটু দেশি, আঞ্চলিক ইত্যাদি চটকদার খবরের পাতা ছেড়ে বাইরের নানা পত্রপত্রিকায় চোখ রাখি। যদি না বুঝি, তবে না বোঝাই ভালো। যদি বুঝি তবে সে উত্তম কথা। আর যদি উল্টো বুঝি বা ভুল বুঝি তবে চরম বিপত্তি।
       এখানেও একটা কথা আছে যদিও, আমি ভেবে পাই না স্বাধীনতার এতগুলো দিন পরেও জাতীয়স্তরে এখনও কোনো খবরের কাগজ ভারতের পূর্বদিক থেকে উঠে এলো না কেন? যদি বলো আমরা ইংরাজি জানি না, তা মিথ্যা, আমরা বড় বড় ইংরাজি জাননেওয়ালা সাংবাদিক জন্ম দিয়েছি এই বাংলা থেকেই, কিন্তু আজ অবধি একটাও জাতীয়স্তরের পত্রিকা কেন বার হল না কে জানে? যদি বলো 'দ্য টেলিগ্রাফ', সে আমাদের এই পাশাপাশি কয়েকটা রাজ্য বাদ দিলে অন্যত্র পাওয়া ভার। অবিশ্যি আর যে কয়েকটা জাতীয়স্তরের কাগজ আছে তাও যে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য বলে তো মনে হয় না, এক 'দ্য হিন্দু' আর 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' ছাড়া, তাও এরা মন্দের ভালো।
       তবে সত্য জানার উপায়? রিড বিট্যুইন ট্যু লাইনস্ পড়ার অভাস মশায়। আর সাধারণ বুদ্ধিটাকে ডিফল্ট মোডে রাখা। ওইতেই যতটা হয়।