হাতটা ঠাণ্ডা বস্তুতে লাগলে ঠাণ্ডা অনুভব হয়, গরম বস্তুতে লাগলে অবশ্যই গরম অনুভব হয়। আবার দুঃখ অনুভব হয়, আনন্দ অনুভব হয়, ফ্রেশ অনুভব হয়, কুল অনুভব হয়। কথা হচ্ছে, এই অনুভবটা কি তবে? অনুভব কি অভিজ্ঞতা, না কোনো অভিজ্ঞতার দরজা? সুখ একটা অনুভব, কিন্তু সেটা অভিজ্ঞতা কি? নাকি সুখের সাথে ঘর করার পর যা জমে যা হারায় - সেই স্মৃতিটা অভিজ্ঞতা? অনুভব স্থায়ী হয় না, অভিজ্ঞতাও চিরস্থায়ী হয় না, তবে অনুভবের থেকে স্থায়ী বেশি। অনুভবের স্মৃতি থাকে? থাকে তো, সেটা শুধুই স্মৃতি, তার কোনো দিশা নেই, তার কোনো বক্তব্য নেই, তার খিদে থাকতে পারে। যেমন আমি কোনো মুখরোচক খাবার খেলাম, সেই খাবারটা আবার খেতে চাওয়ার ইচ্ছাটা আমার সেই সুখের অনুভবের স্মৃতি থেকে জন্মায় কিন্তু সেই খাবারটা খাওয়ার পর যদি আমার কোনো অসুস্থতা হয়ে থাকে, তবে সে আমার অভিজ্ঞতা। বৌদ্ধিক অভিজ্ঞতা।
অনুভবের বিচার ক্ষমতা থাকে না। তার থাকে সুখ আর দুঃখের স্মৃতি বা অনুভব। সে সেই সুখের আর দুঃখের স্মৃতিকে যথাক্রমে আবার ফিরে পেতে বা দূরে রাখার চেষ্টা ক্রমাগত করেই যায়, করেই যায়। নিজের অজান্তেই করে যায় অনেক সময়। নিজের অজান্তে মানে কি? অনুভবকে জানে কে? যে বিচার করে সে না যে বিচারের সাক্ষী সে? আমি। এর আর কোনো উত্তর হয় না। আমি যদি বলি, চেতনা, তবে সে চালাকি হয়, চেতনা আর আমার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? কোত্থাও নেই। আমিই চেতনা, আমিই জেগে থাকা। ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন দেখে সে আমি নই, সে আমার উপচ্ছায়া। আমি না হয়েও আমার ঘুমন্ত অংশ।
আমার আবগে তবে কি? আমাদের দেশে অনেক রসের কথা বলা হয়েছে। বীর রস, বাৎসল্য রস, শৃঙ্গার রস ইত্যাদি। এরা এক একটা আবেগ। এই আবেগেরও কোনো হিতাহিত জ্ঞান নেই। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে সংসারে ভালো-মন্দ বলে যে দুটো কথা আছে, সে না আবগে জানে, না অনুভবে। তারা জানে আমার ভালো লাগা আর মন্দ লাগা। কিন্তু এই ভালোলাগা-মন্দলাগা আর ভালো-মন্দের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা বিশদে বুঝাবার দরকার নেই। সুগারের রুগীর যতই মিষ্টি ভালো লাগুক, সে বিচারের মাধ্যমে জানে যে তা তার পক্ষে খারাপ। কিন্তু এই ভালোলাগা আর মন্দলাগা'র সাথে আমাদের ভালো-মন্দ বোধের যে বিরোধ, তাকে কি খুব সহজ বিরোধ? না তো। কারণ দুটোই যে আমি, বরং আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে অনুভবটা যেন বেশি 'আমি', আমার বেশি কাছের। এই দ্বন্দ্ব মানুষের আদি দ্বন্দ্ব। সে কোনদিকে যাবে তবে? তার ভালোলাগার অনুভব না বোধ-বিচারে জাগা ভালোর দিকে? বহু বছর আগে, ভারতীয় দর্শনে একটা উপায় বলা হল - শ্রেয় ও প্রেয়র কথা এলো। অর্থাৎ যা করা উচিৎ আর যা করতে ভালোলাগে। অবশ্যই বলা হল, শ্রেয়টাই বেশি কাম্য। কিন্তু সে কথা আবেগ বুঝল না, তাই আজও কথায় কথায় আমরা বলি - "বেশি জ্ঞান দিস না তো!” অর্থাৎ যে জ্ঞান আমার ভালোলাগার বিরোধিতা করে, আমায় নিরস্ত হতে বলে আমার প্রিয় কোনো অনুভবের থেকে আমরা তাকে বলি অযাচিত জ্ঞান, শুষ্ক জ্ঞান ইত্যাদি। সিগারেটের প্যাকেটের উপরের সতর্কীকরণ ছবির থেকে আমার সিগারেটের ধোঁয়ার সুখানুভূতি অনেক বেশি কাছের, অনেক বেশি আকর্ষণের। এই বিরোধ, সেই আদিম বিরোধ।
তবে এ কথা স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে যে মানুষের আবগ তার পক্ষে অনেক সময়েই যায়নি, ভুল প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে অনেকটা দূর তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার পর। তবে কি আবেগে শূন্যতাকে নিয়েই বাঁচতে হবে? তখন দুটো কথা এলো, এক, মাত্রাজ্ঞান আর দুই শান্তরস।
মাত্রাজ্ঞান মানুষকে শান্ত রাখে। কিরকম? কথাটা হল এক এক মানুষের সহনশীলতা আর ব্যক্তিত্বের ধরণ এক এক রকম। তাই মাত্রাজ্ঞানের তারতম্য হয়েই থাকে। যদি শারীরিক দিক থেকে দেখা যায় তবে আমরা অনেকটা একই রকম সেখানে, কিন্তু মানসিক দিক থেকে আমরা একই রকম তো নই। পাশ্চাত্য দর্শনে এপিক্টেটাস, অরিলিয়াস, সেনেকা অনেকেই এই শান্তরসের কথা বলেছেন, যাকে বলা হয় স্টোইসিজম। জেনো এর প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের গীতাতেও যখন অর্জুনকে বারবার বলা হচ্ছে সুখ-দুঃখ-জয়-পরাজয়-লাভ-অলাভ-এ শান্ত থাকার কথা, তখন সেই দর্শনের কথাই বলা হচ্ছে। একটা প্র্যাক্টিসের কথা বলা হচ্ছে। একটা মানসিক অনুশীলনের কথা বলা হচ্ছে। এও বলা হচ্ছে যে এ একদিনে হবে না, তোমায় লাগাতার প্র্যাক্টিস করে যেতে হবে, একটা বৌদ্ধিক অনুশীলনের অঙ্গীকার করিয়ে নিতে চাইছেন বুদ্ধ পঞ্চশীলের মাধ্যমে। আবেগের উপর বুদ্ধির জয়, অনুভবের উপর বোধের জয় - এই কাম্য বলা হচ্ছে। তার উপায় কি? বলা হচ্ছে সেই এক কথা - শান্ত থাকতে অভ্যাস করো। বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করো। বুঝতে গেলেই বুদ্ধির ডাক পড়বে। বুদ্ধি কোনোদিন কোলাহলে কাজ করে না। বুদ্ধির কাজের প্রথম শর্তই হল - শান্ত। তাই কোনো পরীক্ষা হলে বা বাজারের মধ্যে করা হয় না, কোনো বিদ্যালয় শোরগোলের মধ্যে গড়ে ওঠে না, কোনো আলোচনা উত্তেজনার মধ্যে সফল হয় না। সব মন্দির-মসজিদ-গীর্জা-প্যাগোডা ইত্যাদিতে মতের, আচারের, বিচারের লক্ষকোটি পার্থক্য থাকলেও একটা জায়গায় সবাই এক - "শান্তি রাখুন"। কারণ মানুষের বুদ্ধির প্রথম শর্তই হল - শান্তি। শান্তি মানে নীরবতা সব সময় নয়, শান্তি মানে সাম্যাবস্থা।
শান্ত রাখার কয়েকটা অনুশীলন, যা আমার ভালো লাগে, পাশ করিনি, এখনো চেষ্টায় আছি -
১) কম কথা বলার অভ্যাস
২) বেশি কথা না বলার অভ্যাস
৩) অপ্রয়োজনীয় কথা না বলার অভ্যাস
৪) মিথ্যা যতটা না বলা যায় তার অভ্যাস
৫) সব না শোনার অভ্যাস
৬) বেশি না শোনার অভ্যাস
৭) নিন্দা না শোনার অভ্যাস
৮) নিজের প্রশংসা না শোনার অভ্যাস
এই গেল অষ্টাঙ্গিক মার্গ। আর কয়েকটা সত্য মনে রাখার অভ্যাস।
১) আমি আছি
২) আমি আগে ছিলাম না
৩) আমি পরেও থাকব না
৪) আমি 'মানুষ' হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, 'আমি' বলে কিছু হয় না।