জেনারেল ডায়ার যেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে দিনের আলোয় প্রকাশ্যে অতগুলো নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষগুলোর উপর গুলি চালিয়েছিল, সেদিন সে ধর্মের দিকে তাকিয়ে কাজটা করেনি। কর্তব্যের দিকে তাকিয়ে কাজটা করেছিল। বিদ্বেষজাত কর্তব্য।
বিদ্বেষ যখন কর্তব্য হয়, তখন সে প্রকাশ্যে আসে নির্ভীকভাবে। কারণ কর্তব্যের নিজস্ব একটা মান আছে। কাশ্মীরে যে জঙ্গিরা হিন্দুদের মেরেছে, তারা সেটাকে কর্তব্যজ্ঞানে মেরেছে। জঙ্গিরা মারার আগে আল্লাহ'র নাম নিতে বলছে, কলমা পড়তে বলছে। এ ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। এমনকি জিনিসটা এমনই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে এই নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে সোশ্যাল মিডিয়ায় রিল, বা মিমও আছে। একজন মুসলিমের ছদ্মবেশে এসে একটা ব্যাগ হঠাৎ করে ভিড়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলছে “আল্লাহ আকবর”। অমনি সব ভয়ে চারদিকে দিগবিদিক শূন্য হয়ে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। এ মিম লজ্জার।
বিদ্বেষকে কর্তব্যে রূপান্তরিত করে, এমন সাংগঠনিকভাবে, আন্তর্জাতিক স্তরে তাকে চালিয়ে যাওয়ার উদাহরণ ইসলাম ধর্মে বারবার এসেছে। এত এত বিদ্বেষমূলক প্রতিষ্ঠান আছে ইসলামে, যাদের মূল কর্তব্য হল বিদ্বেষকে কর্তব্যের স্তরে নিয়ে যাওয়া। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে এমন এক মাত্রায় নিয়ে যাওয়া, যেখানে বিদ্বেষের প্ররোচনাই একমাত্র অবশিষ্ট থাকে। ইরাণের হিজাবকাণ্ড, আফগানিস্তানে আপামর মেয়েদের অবস্থান ইত্যাদি কোনোটাই এর ব্যতিক্রম নয়। ঠাণ্ডা মাথায়, পরিকল্পনা করা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করা, মেয়েদের সীমায়িত করার প্রশিক্ষণ দিয়ে যাওয়া, এমন আচরণ কোনো ধর্মের বিশ্বাসে দীর্ঘদিন দাঁড়িয়ে থাকলে তা একটা প্রথায় পরিণত হয়। এর কারণ হিসাবে অনেক আন্তর্জাতিক ভৌগলিক রাজনৈতিক ব্যাখ্যা আছে। সে সব খুব স্পষ্ট নয়। দাবী যদি ন্যায্য হয় তবে উপায় কেন অন্যায্য হবে - এ সোজা প্রশ্নটার উত্তর আমি আজও পাইনি। মানুষ বারবার শোষিত হয়েছে, লুণ্ঠিত হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে, কিন্তু ন্যায্য লড়াইয়ের পথে নিজের অধিকার অর্জন করেছে - এই তো মানুষের নানা উত্থান, বিপ্লবের ইতিহাস।
বিদ্বেষ মানুষের প্রকৃতিতে আছে। তাকে নির্মূল করা সম্ভব না। কিন্তু বিদ্বেষকে কর্তব্যের স্তরে যাতে না নিয়ে যাওয়া যায়, সে দিকটাই দেখার। কারণ কর্তব্যবোধটা বৌদ্ধিক, আবেগজাত নয়। ক্রমাগত অর্ধসত্য বা ভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে দিয়ে আবেগকে বিষাক্ত করে, বৌদ্ধিক স্তরে তাকেই কর্তব্যের আখ্যা দিয়ে দেওয়া - এ ভালো নয়। মানুষ বৈচিত্র্যময়। গোটা বিশ্বকে একটা বিশ্বাসের নিগড়ে আনার মত বিদ্বেষমূলক মনোভাব আর কিছুই হয় না।
ভিএস নাইপাল থেকে শুরু করে, স্যাম হরিস, তসলিমা নাসরিন অবধি বহু বহু বুদ্ধিজীবী মানুষের লেখায় ইসলামের এ দিকটা আলোচনায় এসেছে। কিন্তু আপামর বিশ্ববাসী মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরাই কি বিশ্বাস করেন বিদ্বেষের বাস্তবায়নই একমাত্র ধর্মীয় কর্তব্য? এ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ধর্মহীন মনুষ্যসমাজ হয় না। এ কথা আম্বেদকর স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন। কিন্তু কোনো ধর্ম যখন বিদ্বেষকে সাংগঠনিক কর্তব্যের স্তরে নিয়ে যায়, তখন তা নিয়ে সোচ্চার হওয়া, বারবার প্রতিবাদ করা সে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরই কাজ। স্বামী বিবেকানন্দ যদি কোনো ধর্মের কড়া সমালোচনা করেছিলেন সে নিজের ধর্মের। সন্ত কবীর দুই ধর্মেরই সমালোচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন বারবার এ কাজ করেছিলেন বলে সমাজ তথা ধর্মবোধ সংস্কার হয়েছে বারবার। কদিন আগের ভারতের প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালাম একই শ্বাসে বিজ্ঞানের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রী অরবিন্দের নাম উচ্চারণ করেছেন। সেও সংস্কারের দৃষ্টিতেই। ধর্মহীন হওয়া যেমন মানুষের পক্ষে সম্ভব না, তেমনই ধর্ম সংস্কারহীন হয়ে থাকাটা ভীষণ অস্বাস্থ্যকর। সমাজে কোনো অস্তিত্বই সংস্কারহীন হতে পারে না।
ভারতের প্রাচীন ধর্ম অনেক বড় বড় মহাত্মাকে জন্ম দিয়েছে। আপনি মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ বোস, আম্বেদকর প্রমুখের কঠোর সমালোচক হতে পারেন, কিন্তু তাদের দাগী আসামী ভাবতে পারেন না। সে ভাবতে গেলে বা ভাবাতে গেলে সত্যভ্রষ্ট হতে হয়। আর সত্যভ্রষ্ট মানুষ আলোচনার বিষয় হতে পারে না, তার অকথনীয় কিছুই নেই। তারা জানতেন মানুষের মানুষ হিসাবে প্রাথমিক কর্তব্য বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ওঠা। বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ওঠা মানে কখনোই এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়া না, তার জন্য যে কঠোর পদক্ষেপ দরকার তা দরকারই, কিন্তু সে কঠোর পদক্ষেপ যেন অন্যায্য না হয়। একই ঘটনা ইজরায়েলে হামাস ঘটিয়েছে। কিন্তু হামাসকে শেষ করতে হিয়ে গাজার যে পরিস্থিতি সেও কি কাম্য? কখনওই না। নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের রক্তক্ষরণ ইতিহাস কোনোদিন ক্ষমা করেনি। এ কথাটা মনে রাখার। আজ এই ভয়ংকর রাগের সময়, ক্ষোভের সময়, ভীষণ অসহায়তার সময় অনেকেই অনেক কথা বলছেন, যা অতিকথন, যা হয় তো রাগের মাথাতেই বলছেন। সে স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য যদি আরো কোথাও আগুন জ্বলে, সে দায়টাও তো আমারই। সামাজিক মাধ্যমে কী লিখছি সে দায় আমার থাকতেই হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, হনুমান রাগের মাথায় গোটা লঙ্কা জ্বালিয়ে দিল, এটুকু বোধ ছিল না সেই লঙ্কায় আমার সীতাও আছেন। আমাদের সীতা হলেন আমাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। যা সুবুদ্ধি আর সহিষ্ণুতার উপর দাঁড়িয়ে। রাগের মাথায় যেন সেখানে আগুন না জ্বালি। কঠোর বিধান আনুক রাষ্ট্র, কিন্তু নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে না। দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধেই।