Skip to main content
শিবগুরু বনাম কর্পোরেট-গুরু


কালকের Times of India'র প্রথমপাতায় চোখ পড়তেই 'রাজা' নাটকটা মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের। সেখানে বলা হচ্ছে, 'তিনি সবখানেই আছেন বলে কোনোখানে বিশেষ করে নেই'। রবীন্দ্রনাথ আজকের কাগজটা দেখলে লাইনটা সংশোধন করতেন কিনা বলতে পারি না। হয় তো আজকের গুরুরা বলতে চান - 'তিনি কোনোখানেই নেই বলে একজায়গায় বিশেষ করে আছেন'। 

আজ শিবরাত্রি। গতকালই ভারতের জনপ্রিয় খবরের কাগজের প্রথমপাতায় মহাদেবের উচ্চতম মর্মর মূর্তির উন্মোচনের বিজ্ঞাপন। তাও দু'পাতা জুড়ে। এই বিজ্ঞাপনের দরুণ কি বিপুল খরচ হয়ে থাকবে সে অনুমেয়, আরো সহজেই অনুমেয় ওই প্রকাণ্ড মূর্তিটি বানাতে কি পরিমাণ খরচ হয়ে থাকবে। এত টাকা আসে কোত্থেকে? ভক্তদের থেকে। কি ধরণের ভক্ত? দুঃস্থ ভক্ত। উঁহু, দুঃস্থ বলতেই ছেঁড়াজামাকাপড়, লো ব্যালেন্স বোঝায় না। যারা প্রতিদিনের স্ট্রেস সামলাতে না পেরে আধ্যাত্মিক নিরাময়ের পথ খোঁজেন, তাদের কথা বলা হচ্ছে। সেই প্রয়োজন মেটাতেই জন্ম হয়েছে নতুন এক প্রকার সম্প্রদায় - কর্পোরেট গুরু। 
মানুষের নানান জিজ্ঞাসা। মোটামুটি দুই প্রকার যদি ভাবি - জাগতিক আর পরাজাগতিক। জাগতিক প্রশ্নের মীমাংসার পর আসে পরাজাগতিক নানান প্রশ্ন (সকলের না অবশ্য)। সে মীমাংসা করার প্রাচীন পদ্ধতি ছিল অলৌকিক, কাল্পনিক ব্যাখ্যা। যার অনেকটা অংশ রিলিজিয়নের অংশীভূত (আমি ইচ্ছা করেই 'ধর্ম' শব্দটা ব্যবহার করলাম না, তার অর্থ অনেক গভীর), নানান পৌরাণিক কাহিনী। তারপর সে জায়গা নিল দর্শন, যুক্তি। মানুষ খুব গর্বের সাথে স্বীকার করতে শিখল - সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। আর সীমারেখাটা মানার মধ্যে কোনো লজ্জাও নেই। তবু শ্রদ্ধা নির্ভর আরেকটা পথের অস্তিত্ব থেকেই গেল, যাকে বলি ভাববাদ বা মরমীবাদ। সে পথে যুক্তি চলে না। তার কারণ এ নয় যে সে যুক্তির বিরুদ্ধে, কারণ সে যুক্তির অগম্য। সে পথের প্রধান বাহক প্রেম। প্রেমকে বাদ দিলে যা থাকে শুধুই রহস্য, অন্ধকার রহস্য। 
মানুষের দুটো সমস্যা। জাগতিক আর তাত্ত্বিক। জাগতিক সমস্যাবলীর সমাধানের তার নানান পথ- বিজ্ঞান, নানান নীতি ইত্যাদি। আর তাত্ত্বিক সমস্যা? সেরকম মানুষ আমি অন্তত এতবড় জীবনে দেখলুম না, যিনি কোনো তাত্ত্বিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলছেন। বইতে অবিশ্যি পড়েছি এমন মানুষ কালেভদ্রে জন্মেছে এই ধরাধামেই। তাঁরা মাথায় থাকুন। তবে কি ছদ্ম তাত্ত্বিক সমস্যাও হয়, কিছু জাগতিক সমস্যার মত। ছদ্ম জাগতিক সমস্যাকে যেমন শৌখিন সমস্যা বলা যায়, তেমনই ছদ্ম তাত্ত্বিক সমস্যাকে নিছক কৌতুহলের গোত্রে ফেলা যায়। সে যাই হোক, সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্য - শান্তি পাওয়া। আমার শান্তি চাই, সলিড শান্তি। সে অ্যাল্প্রাজোলামই দিক, কি গুরুই দিক – I need relaxation. মনে রাখতে আমরা শান্তি অর্থে peace বলতে চাইছি না, কারণ কোনো বুদ্ধিমানই ওটা বাইরে থেকে চান না, ওটা উৎপন্ন করেন নিজের মধ্যে। আর সে পথটা চিরকাল ত্যাগের মাধ্যমেই আসে, সে পেটের মল হোক বা অতিরিক্ত চাহিদা বা লোভ হোক। না ছাড়লে গতি নেই। কিন্তু রিল্যাক্সেশানে তো সে শর্ত নেই। জন্ম হল কর্পোরেট গুরুর। 
ভেবে দেখুন সেই বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, সক্রেটিস, নানক, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ ইত্যাদি বোকা লোকগুলোর কথা। ঠাকুরের ভাষায় 'পোঁদের কাপড় ঠিক না থাকা' লোকগুলোর কথা। কি বোকামিই না করেছেন তেনারা। মানুষকে বলেছেন বড় হওয়ার কথা, ত্যাগের কথা। কোথায় একটু রিল্যাক্স করবে মানুষ, সে শিক্ষা দেবে...না কি সব কঠিন কঠিন কথা বলে সাধের প্রাণটা খোয়ালে। আজ কেমন তাদের শিষ্যেরা সে ভুলটা ধরতে পেরেছে দেখুন। এসি ছাড়া কথাই বলে না, সর্বভুতে ব্রহ্ম না দেখুক লক্ষীকে তো অবশ্যই দেখছেন। এই নিয়ে বেশ কিছুকাল আগে দস্তোয়েভেস্কির 'ব্রাদার্স কারামাজোভ' এর একটা অভিনীত অংশ ইউটিউব থেকে তুলে দিয়েছিলাম - দ্য গ্রেট ইনকুইজিটার। সেখানে দেখানো হয়েছিল, আজ যদি যীশু এসে কোনো মতে রোমে পোপের প্রাসাদে গিয়ে পৌঁছাতেন তবে কি দশা তারা মানুষটার করত। সব প্রতিষ্ঠিত ধর্মেরই এক অবস্থা কম বেশি। 
কথা হল তাদের শিষ্যেদের নিয়ে নয়। তাদের অত ক্ষ্যামতা নেই। কিন্তু এই কর্পোরেট গুরুদের কার্যকলাপে নজরদারি করবে কে? মুশকিল হচ্ছে যে বোকা বনতেই সুখ পায়, বিশেষ করে বিজ্ঞজনের কাছে বোকা বনার মধ্যে যে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, সে আত্মতুষ্টির জগতে 'রাজা তোর কাপড় কোথায়' বলার লোক কই? কদিন আগে খুব ভক্ত দুজন মানুষের কাছে শুনলাম জয়রামবাটিতে মা সারদার মূর্তিটা নাকি ক্রমশঃ মুখ ফিরিয়ে নাট মন্দির থেকে মাঠের দিকে তাকাচ্ছে, সেখানে বেশি লোক ধরবে বলে। যারা বললেন, তারা সংসার ত্যাগ করে ফুল টাইম ভক্ত। চমকে উঠলাম, যে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সারাটা জীবন সব রকম অলৌকিক, বুজরুকি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বলে গেলেন তাদের শিক্ষার ধীরে ধীরে এ কি পরিণতি হচ্ছে? বললুম, সেখানে যে গুরু আমায় চেনেন না তিনিই নাকি আমায় দীক্ষা দিয়ে ইহকাল-পরকালের সুব্যবস্থা করে দেবেন এমন কথা আছে। তারা বললেন, তারা নাকি এত উচ্চে থাকেন তাদের ব্যক্তিগতভাবে কাউকে জানার প্রয়োজন হয় না। মনে মনে ভাবলুম তবে রামকৃষ্ণদেব বা সারদাদেবী অথবা তাদের সরাসরি পার্ষদরা বোধ হয় অতটা উঁচুতে উঠে পারেননি। তারা তো শুনেছি আগে ভাব জেনে তবে দীক্ষা দিতেন। যেই না সে কথা বলা, অমনি তারা ক্ষেপে উঠলেন। যুক্তি পাল্টে গেল, বললেন - অত গভীরের কথা জানার ক্ষমতা তাদের নেই। বললুম, নেই যখন তখন সে পথটাই বন্ধ করে দিলে হয়। উপযুক্ত চিকিৎসক না থাকলে শুনেছি কম্পাউন্ডারে সে কাজ কিছুটা চালিয়ে নেন, সে তত্ত্ব ভাবজগতেও হানা দিয়েছে শুধু না, ভালো রকম গোড়াপত্তন করে বসেছে দেখে আতঙ্কিত হলাম। কারণ ওই যে - যে ঠকছে, সে যদি চোখ-কান বন্ধ রাখাকেই উৎকৃষ্ট ভক্তি বলে মনে করেন, তবে তো আর কথাই নেই। আরেক সম্প্রদায়ে দেখেছি - 'সবার মধ্যেই এক নারায়ণ' এমন সুন্দর ভাবোদ্দীপক কথাকেও বলা হচ্ছে, আবার 'অন্যের হাতে খাওয়ায় শুদ্ধতা নষ্ট হবে' এমন অপমানজনক কথাও একই সাথে উচ্চারিত হচ্ছে। অসুবিধা নেই, বিবেক ঘুমাচ্ছে যে। 
যত দিন যাচ্ছে, যত মানুষ যোগ্য কনজিউমার হয়ে উঠছে, তত তার সাধারণ বুদ্ধিগুলোর ধার কমছে কি? না হলে অত কোটি কোটি টাকা ডোনেশান দিয়ে শান্তি কিনতে যায় কোন মূর্খামিতে? যে পথে ত্যাগ নেই, সেবা নেই, সরলতা নেই, সমদর্শিতা নেই, আত্ম-সমালোচনা নেই - সে কোন ধর্মের পথ? সে গুরুরা কোন ধর্মের গুরু? সে পথের পথিকেরা কোন জগতের অন্বেষণে? অন্তর্যামীর বাজার দর কমেছে বলেই না আজ এতবড় মূর্তির আয়োজন! ঘুমন্ত বিবেককে ঘুমাতে দাও। সে জেগে গেলে শান্তি বিঘ্নিত হবে। জাগ্রত অহং এর গোড়ায় ঢালো জল। যত বড় আয়োজন, তত তার আস্ফালন। তত সে বিত্তশালী। ভিতরের কতটা দীনতা চাপা দিতে এতটা ঐশ্বর্যের মোড়কে ঈশ্বরকে ঢাকতে হয় সে বিচার করবে কে? 
একটা গান মনে পড়ছে। মহাপ্রভু সম্বন্ধে - 
                 "একি অপরূপ কথা, কহনে না যায় 
                        গোলোকেরই নাথ হইয়া ধুলায় লুটায় 
                              হায় হায় চন্দনে লেপিত অঙ্গ ধুলায় লুটায়” 

সে ধুলা গায়ে মাখব বলেই বসে থাকা। যে আমায় ভরে দেবে তার জন্যে পথ চাওয়া নয়, যে আমার সর্বনাশ করবে তার জন্য পথ চাওয়া। 

“যে করে আমার আশ, তার করি সর্বনাশ 
তাও যদি করে আশ, হই তার দাসানুদাস”