Skip to main content
 
 
 
      শুভবুদ্ধি কি? পাঠ নির্ভর? না। শুভবুদ্ধির উৎস কি তবে? বইপড়া জ্ঞান মানুষকে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন করে না, এ বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে প্রতিটা পরীক্ষায় আর এতগুলো নিয়ম বানাতে হত না টুকলি থেকে বাঁচার জন্য। এত সিসিটিভি, এত চেকিং। যত উঁচুদরের পরীক্ষা তত নিয়মের আধিক্য, প্রায় অন্তর্বাসটুকু খুলে হলে ঢুকতে হয় এমন নিয়মকানুনের বহর সেখানে। অর্থাৎ প্রমাণিত হচ্ছে যে মানুষের দুষ্টবুদ্ধি বইয়ের অক্ষর চাপা পড়ে মরেনি, মরে না। সেখানে ‘কাজের মানুষ’ বানানো হয়, মানুষ বানানো হয় না। 
      অনেকবার শুনেছি – মানুষ গড়ার কারিগর। কথাটা ধোঁয়াশা লাগে। মানুষ বলতে আমরা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন জীবই বুঝি। এখন গোড়ার কথা হল, বললেই যদি বুঝবে তবে গীতাটা কৃষ্ণ মহাশয় দুর্যোধনকে বলতেন, অর্জুনকে নয়। এই ইঙ্গিতটা খুব একটা বড় ইঙ্গিত শুভবুদ্ধির খেই খোঁজার জন্য। কেমন একটু বিশদে বলি। 
      আমায় একটা কথা অনেকবার শুনতে হয়েছে – আপনি/ তুমি যা বলছ তা তত্ত্বগতভাবে ঠিক, কিন্তু আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা তা না। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক বেশি তোমার/ আপনার থেকে, আমি যা জেনেছি জীবন থেকেই জেনেছি, অর্থাৎ আমি অব্যর্থ ঠিক, তুমি শৌখিনগতভাবে ঠিক, আদতে ভুল। 
      আগে এই জটিলতাটা কাটিয়ে নিই। একজন মানুষকে বহুযুগ আগে প্রায় সবাই বলেছিল, সূর্য স্থির আর পৃথিবী যে ঘুরছে, সে কথাটা তুমি তত্ত্বগত বৌদ্ধিক অহংকারে বললেও, আদতে কিন্তু ঠিক নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, পৃথিবী স্থির, সূর্য ঘুরছে। 
গল্পটা আমাদের জানা। মানুষটাকে কি লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল, সেও আমাদের জানা। শুভবুদ্ধির কথাটাও তেমন। তুলসীদাসজী বলছেন, সারাজীবন অমৃতের কথা শুনেই গেলাম, আর চোখে দেখলাম শুধু বিষ। এই শ্লেষাত্মক কথাটার মধ্যে সত্যের দ্যোতনায় বেজেছে। অর্থাৎ যা কিছু শুভ তা আমার অন্তঃস্থলে প্রজ্ঞার মধ্যে সুপ্তাবস্থা থেকে ক্রম বিকশিত। মানুষের সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়েছিল বর্বতার মধ্যে দিয়ে। ক্রমে তা মার্জিত হয়ে একটা সুসংহত সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলল। একটা পরিপূর্ণ, আদর্শ সমাজের ছবি যেন মানুষের প্রজ্ঞার গভীরে আছেই। সেই ছবিকে সে পূর্ণতার রূপ দিতে চাইছে। সব ক্ষেত্রে। সে যেন ভিতর থেকে বাইরে নিজেকে প্রকাশিত করে চলেছে লক্ষ ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে। তবু সে দমে যাচ্ছে না। যেন সেই পূর্ণতার উপর তার আজন্ম অধিকার। সে যদি সেই আদিম বর্বরতার অভিজ্ঞতাকেই চরম জেনে থেমে যেত তবে অসম্ভব ছিল এতটা রাস্তা এগিয়ে আসা। সামঞ্জস্য, সহাবস্থান, সভ্যতাস্থাপন – এর ছবি তার মনের মধ্যেই ছিল। পশুর হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ একত্রে বাঁচতে শুরু করেছিল, ইতিহাসের এই কথাটা আমার কেমন সম্পূর্ণ সত্যি কোনোদিন লাগেনি। এখন যত বয়েস হচ্ছে তত আরো মিথ্যা মনে হচ্ছে। 
      বর্তমানের দর্শন বলে, আমাদের বোধের এ বিশ্ব না তো সম্পূর্ণ চেতনা না সম্পূর্ণ জড়। দুইকে নিয়ে একটা সৃষ্টি। কেনো উপনিষদ বলে, যদি তুমি অবিদ্যার আরাধনা করো তবে তুমি অন্ধকারে পতিত হবে, আর যদি তুমি শুধু বিদ্যার আরাধনা করো তবে আরো অন্ধকারে পতিত হবে। এও কি সেই জড়-চেতনের যুগ্ম অবস্থানের কথা বলতে চাইছে? বর্তমান যুগের একজন মহান স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যান্টোনিও দামাসিও দুটো বিখ্যাত বই লিখেছেন, এক, দার্শনিক দেকার্তের দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতা নিয়ে (Descartes’ Error), আর দুই, স্পিনোজার দর্শনের সারবত্তা নিয়ে (Looking For Spinoza)। স্নায়ুর গতিপথ, স্নায়বিক কার্যাবলীর সূত্র নির্ধারণের মাধ্যেম আত্মসত্তার খোঁজ এক অসামান্য প্রয়াস যা দামাসিওর গবেষণার মধ্যে বারবার আসছে। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ – অনুভব ও আবেগ নিয়ে। অন্য অর্থে অনুভব ও আবেগের বিজ্ঞান নিয়ে। 
      পূর্ণতার বোধ মানুষের মননের, অভিজ্ঞতার না। আমরা যত অভিজ্ঞতা নির্ভর, আমরা তত সীমাবদ্ধ। আমরা যত মনন নির্ভর আমরা তত কল্পনাবদ্ধ। এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য ঘটায় যে, সেই আমাদের শুভবুদ্ধি। তবে কি তা ফ্রয়েডের ইদ-ইগো-সুপারইগো? না। শুভবুদ্ধি সেই ইগোর একটা ক্ষীণ আভাস। কিন্তু শুভবুদ্ধির শিকড় আরো গভীরে, প্রকৃতির আরো নিবিড় রহস্যালয়ে। 
      শুভবুদ্ধির উৎস খুঁজতে আমাদের স্নায়ুবিজ্ঞানের সাথে হাঁটার সময় এসেছে। আমাদের দর্শন, আমাদের এথিকস, আমাদের সমাজচেতনা, ব্যক্তিচেতনাকে বুঝতে আমাদের স্নায়ুবিজ্ঞান আরো সাহায্য করবে। মস্তিষ্ক একটা জটিল গ্যালাক্সি। তার মধ্যে যেন একটা ব্ল্যাকহোল কোথাও, হয়ত যা মানুষের ধ্যানের পরম সত্য – ঈশ্বর। রামকৃষ্ণের উপমার সেই বাড়ির গিন্নীর সবকিছু জমিয়ে রাখা কৌট। মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচনের সাথে সাথে মানুষের চেতনার নানা দিক উন্মোচিত হবে। আমাদের সমস্ত চিন্তা, চেতনা, আবেগ, অনুভব – কোন মাটি থেকে নানা রূপ হয়ে আমাদের ব্যক্তিসত্তায় বিচ্ছুরিত হয়ে চলেছে রাতদিন? মস্তিষ্কের কোন প্রদেশের কোন জটিলতায়, কোন অনুরণনে মানুষের আত্মচেতনা জাগ্রত হচ্ছে? আত্মপরিচয় লোপই বা পাচ্ছে কোন প্রদেশের ল্যাণ্ডস্লাইডে? খোঁজো, খোঁজো। আজ বিজ্ঞান-দর্শন-ধর্ম একসাথে একটা পরিচয় খুঁজতে চেষ্টা করছে। মহান মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়ুং তার শেষ গ্রন্থে ( Man And His Symbols) ধর্মের নানা প্রতীক ও তার ব্যবহার নিয়ে একটা অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপ আলোচনা করেছেন। আর সবার ছুঁৎমার্গ থাকতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানের ছুঁৎমার্গে হাঁটলে চলে না। তাকে যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই তত্ত্ব মেনে চলতেই হয়। তাই ঘটছেও। 
      তবে শুভবুদ্ধির উৎস কি? জানি না। আমরা এতটা সে জানি আছে, আমার অস্তিত্বের আদিমলগ্ন থেকেই আছে। তার ব্যতিক্রম হওয়াটাকেই আমরা বলছি – অসভ্য, বর্বর, আদিম। নানা ‘প্যাথ’ যোগ করছি নানা শব্দের পিছনে, সাইকোপ্যাথ, সোসিওপ্যাথ ইত্যাদি। মূল কথাটা হল যে আমাদের শুভবুদ্ধির দিকের পথ, যা আবুল ফজলকে আকবর বলেছিলেন, ‘রাহ আকল’ – এই হবে সভ্যতা গঠনের পথ। 
      শেষ প্রশ্ন। বুদ্ধি কি অশুভ হতে পারে? আমি এই কথাটাই বলে আমার বকবকানি শেষ করব। আমার নিজের বোধ বলে হতে পারে না। একজন মানুষ খুন করছে, ধর্ষণ করছে, বোমা বাঁধছে, এ সব কি কোনো বুদ্ধির প্ররোচনায়? তাই কি? আমার মনে হয় এর জন্য দায়ী, বিকৃত বিশ্বাস। বিশ্বাস বলতে আমি সচরাচর যা বোঝায়, ধর্মে বিশ্বাস, অমুকে বিশ্বাস ইত্যাদি বলতে চাইছি না। আমি যা বলতে চাইছি তার যোগ্য কোনো শব্দ আমি জানি না। তাই এই ‘বিশ্বাস’ শব্দটাকেই আমি ব্যবহার করতে চাইছি। বিশ্বাস বলতে আমি তাই বলতে চাইছি যা - আবেগের ‘হ্যাঁ’। সে ‘হ্যাঁ’ না-এর দিকেও হতে পারে। সে ‘হ্যাঁ’ ধ্বংসের দিকেও হতে পারে। এমনকি আত্মধ্বংসের দিকেও হতে পারে। এই বিশ্বাস শব্দটা অনেকটা আকরিকের মত। তাকে মার্জিত করতে যে আলো প্রতিফলিত হয় তার উপর তাকেই কি আমরা বুদ্ধি বলি না? যে বুদ্ধি তার গভীরে গিয়ে যেটুকু ভালো তাকেই স্বীকার করে নেয়, বাকিটাকে হয় ফেলে দেয়, নয় নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চায়। আজ কাউকে গারদে ভরে রেখে যে কাজটা আমরা করি, তার সে প্রবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয় রাখার চেষ্টা করার জন্যেই তো। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, মানুষের মধ্যের একটা বিকৃত শক্তিশালী বিশ্বাস তাকে অসামাজিক, অন্যায়াকারী, দুর্বৃত্ত গড়ে তুলছে। বুদ্ধি কখনও মন্দ হয় না। হতে পারে না। এই আমাদের একমাত্র সম্বল। তাকে গড়ে তুলতে হবে যদি বলি, সে অগভীর কথা, তাকে আবিষ্কার করতে হবে। এই আবিষ্কারের নামই জীবন – সাধন। তাই এত অহং নাশের কথা। কেন? বলছি। 
      মানুষের দুটো আমি সত্তা – এক, তার ব্যক্তিসত্তা, দুই সামাজিক সমষ্টিগত ‘আমিসত্তা’। এই দ্বিতীয় ‘আমিসত্তা’-র মানুষ পাওয়া সব যুগেই বিরল। যারা সেই স্তরে পৌঁছিয়েছেন তারাই বুঝেছেন ব্যক্তি মানুষের মধ্যে যে সমষ্টিমানুষের বোধ আছে, সেই বোধকে জুড়ে যে আমি তৈরি হয় সে আমাদের বুদ্ধি-যুক্তির অতীত, কিন্ত সেই আমাদের পরম ধারক বাহক। তাকে যে নামেই চিহ্নিত করি না কেন, অবশেষে স্পিনোজার সেই অনন্ত-অসীমের বোধই আমাদের এগোবার দরজা। যা স্পিনোজার ঈশ্বর। মানুষের সাথে সাথে ঈশ্বর শব্দটারও যেন শুদ্ধিকরণ হল স্পিনোজার দর্শনে। আজ স্নায়ুবিজ্ঞানের সূত্রও বলতে চাইছে, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”...কিম্বা, “অনন্তের তুমি অধিকারী, প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান”। সেই অনন্তের ডানার শব্দই আমার বুদ্ধি, তা কোনোদিন মলিন হতে পারে না। হবেও না। মেঘে ঢাকতে পারে। তাও বা কতদিন?