Skip to main content

মানুষের চাহিদার শেষ নেই। ধন,মান,যশ ইত্যাদি ইত্যাদি। কত কত মহাপুরুষেরা সাবধান করে গেলেন যুগ যুগ ধরে, 'ওরে অত চাস নে, চাস নে', তা কে শোনে কার কথা! আমিও শুনিনা, তুমিও শোনো না, রাম শ্যাম যদু মধু কেহই শোনে না।
        কথা হচ্ছে মাটি চাই, না ধূমকেতু চাই। এ কেমন কথা হল, ধূমকেতু কি একটা চাওয়ার জিনিস? তা বটে। কিন্তু তবু চাই যে। তা এই ধূমকেতু বস্তুটি কি? খ্যাতির ইচ্ছা গো। একটু কাব্য করে বললুম আর কি। এখন খ্যাতির ইচ্ছা কার না করে? ভালো রাঁধলে, লিখলে, গাইলে, নাচলে, অ্যাক্টো করলে, ফটো তুললে, ছবি আঁকলে, খেললে ইত্যাদি রে ইত্যাদি...বাপ রে হাঁপ ধরে গেল! তা এইসব কিছু করলে লোকে 'ভালো হয়েছে...ভালো হয়েছে' বললে মনের মধ্যে কেমন একটা গোলাপী রঙের ধোঁয়া ধোঁয়া নেশা ধরে না? বেশ ধরে। ওটিই তো হল অহং এর গায়ের রঙ গা। যখন ও খুব খুশী হয়, তখন অমন গোলাপী রঙের হয়ে যায়। আর কোনো কারণে যদি রেগে গেল, বা অসন্তুষ্ট হল, মাগো মা, এমন ধারা ফুঁসবে না। গা পুরো লালে লাল! হুম! সে যাকে পারে তাকে আঁচড়ায় তখন, এমনকি বাগে কাউকে না পেলে নিজেকেও। আরে হ্যাঁ, নইলে বলছি কি। উফ্‌, রাতের ঘুম কাবার, খাবার হজম হয় না, বাহ্য দুব্বল হয়ে তরল, কানের ভিতর গরম হাওয়া, গালের উপর তপ্ত তাওয়া, আর মাথার মধ্যে পার্লামেন্ট। এ বসে তো ও ওঠে, ও ওঠে তো সে বসে। বাপ রে বাপ! আর বাপ, সেও কি এসব ঝ্যালেনি গা, খুব ঝেলেছে।
        তো এই হল যশের চাহিদা। যশ মানে শুধু নোবেল, ভারতরত্ন, অমুক তমুক পুরষ্কার কইতাসি না, যশ মানে হইল গিয়া, আমি যে আছি সে বেশ করে লোকের মাঝে জানান দেওয়ার উশখুশেপনা। তা, ইহা কি মন্দ? আর মন্দ বললেই বা নোকে শুনবে কেন? গীতায় কেষ্ট ঠাকুরের একটা কতা আমার হেব্বি মনে ধরে। অজ্জুন তো বেটা ভেবেছিল, বেশ সেন্টু খাইয়ে যুদ্ধুটুদ্ধু থেকে সরে যাওয়া যাবে। যা ভয় পেয়েছিল। আহা আমাদের মত পাড়ার দাদাতুতো ভয় না। এ ভয় হল পারিবারিক ভয়, স্নেহের দুব্বলতা, যা কোনো ভিটামিনেই যেত না, যদি না কেষ্টবাবাজী অমন মোক্ষম দাওয়াইটি দিতেন। কি ভাবছেন? এই ফাঁকে গীতা বোঝাব? সে গুড়েবালি কত্তা, বলার কথাডা বইলে কেটে পড়ব। তা অজ্জুনের ভয় সেঁটকে পড়া দেখে কিজনো ঠাকুর বললেন, এত ভয় কিসের বাওয়া...এমন লাট খেলে তো আর মোক্ষোটোক্ষ মিলবেনি চাঁদু...উঠে পড়ো...ঝাড়ো উন শালে কো এক এক করকে...। অজ্জুন ফের কাঁদে, ফের সেন্টু দেয়। তখন আমাদের কিজনো ঠাকুর ভাবলেন, এ তো মাল ভালো কেঁচিয়েছে। এডারে থার্ড ডিগ্রী না দিলে তো আর চলতিসে না। তো তখন তিনি এটাসেটা বলে বললেন, দ্যাখো বাওয়া...জন্মে থেকে ওই এক যুদ্ধু করতি তো শিখেসো...বলি মাষ্টার হবে, টোল খুলবে, ব্যাবসা বাণিজ্য করবে...এসব তো হবেনি তোমার দ্বারা। এমনকি দশটা পাঁচটা রিকশা চালালেও তো পেস্টিজে লাগবে। তার চাইতে যা করতে এয়েচো তাই করো বাওয়া...বলেই সে মোক্ষম কথাটা বললেন, নিগ্রহ কিং করিষ্যতি...মানে আর বারণ করলি কে আর কথা শুনচে বলো...যে যার প্রকৃতি দ্বারা চালিত। বেসিক নেচারটা যাবে কোতায় বাপু...তুমি এখানে যুদ্ধু না করলে, বাড়ি গিয়ে হুক্কলের সাথে যুদ্ধু বাধাইবা, ও যে তোমার তোমার রক্তে বাবা!
        তো কথাটা হল, বারণ করলেই বা লোকে শুনবে কেন? আর বারণই বা করবে কেন? যশের ইচ্ছা বলো, কি খ্যাতির ইচ্ছাই বলো, সে তো আমাগো বেসিক ইনস্টিংক্ট, নাকি? কিন্তু কথাডা তবে শুরুতে কি বললাম, যে মাটি চাই না ধূমকেত?
        ঠাট্টা থাক। আজ ব্লু হয়েলই বলো, আর ইজ্জত রাখতে 'হনার কিলিং' ই বলো। একই জিনিস কিনা? মানুষ কি অনায়াসে নিজের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাজারে ঝুলিয়ে রাখতে পারে বলো, শুধু একটু বিখ্যাত হবে বলে। কি সব্বোনেশে নেশা। নিজের স্বাভাবিকতা, সুস্থতা, ক্ষমতার বাইরে কিছু ভোগ করতে গেলে তা নেশাই তো হয়ে দাঁড়ায় না? আজ সেই নেশার নানান পোশাকি নাম। বিকোচ্ছে দেদার। লক্ষ লাশের উপর তৈরি হচ্ছে ভোগায়তন। কে পড়ল, কে মরল কেউ তাকাচ্ছে না। সময় নেই। তার জায়গাটা ফাঁকা হলে আমি চড়ব যে! এ সবই তো আমরা জানি। কিন্তু দম না ফুরোলে যে থামা যাচ্ছে না। সামনে খাদ দেখতে পেলেও না। মনে মনে বলছি ওতেই তো সবাই ঝাঁপিয়েছে, আমিও ঝাঁপাই...মেজরিটির সাথে চলো।
        অন্যভাবে যদি দেখি। কেউ অটোগ্রাফ নিল, কেউ সেলফি তুলল, মোদ্দা কথা একজন সেলিব্রিটি হওয়া গেল। তাতে কি ভিতরের পাত্রটা পূর্ণ হল? শান্তি এলো? স্থিরতা এলো? ভাগ্যবলে বেশ কিছু সেলিব্রিটি মানুষের কাছে আসার সুযোগ হয়েছে। পাশে থেকে দেখেছি, খ্যাতির টানাপোড়েনে সে সত্যকারের ভিতরের মানুষটা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। একটা ঘটনা মনে পড়ল। চার্লি চ্যাপলিনের অটোবায়োগ্রাফিতে পড়েছিলাম। তিনি তখন ট্রেনের টয়লেটে। অর্ধেক সেভ হয়েছে সবে। ট্রেন দাঁড়িয়েছে। টিটি এসে বললেন, আপনাকে দেখার জন্যে মানুষ ভিড় করে আছে বাইরে। আপনি যদি একবার বাইরে আসেন। তিনি বাইরে এসে লোকের সেই উচ্ছ্বাস উন্মাদনা ইত্যাদিতে ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল হয়ে যান। তারপর নিজের কোচে এসে একটা বিষাদের মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর মনে হয়, বিখ্যাত হওয়াটা এত সস্তা, এত অন্তঃসারশূন্য!
        আরেকটা ঘটনা বিখ্যাত লেখক উইল ডুরান্টের জীবন থেকে। তিনি সমুদ্রের ধারে বসে আছেন। ততদিনে তিনি বেশ বিখ্যাত। তাঁর পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের গল্প তখন অত্যন্ত জনপ্রিয় বই। তবু নিজের ভিতরে কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করছেন যেন। হঠাৎ দেখলেন দূরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। তার পাশে বসা একজন মহিলা তার বাচ্চাটাকে নিয়ে দৌড়ে সে গাড়িটার দিকে এগোলেন। ভদ্রলোক বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে শুরু করলেন, আর বাচ্চাটা 'বাবা বাবা' বলে সে ভদ্রলোকের গালে চুমু খেতে লাগল। ডুরাণ্টের চোখ জল এলো। তিনি অনুভব করলেন, একজন মানুষের আসল শান্তির জায়গা তার পরিবারের, তার কাছের মানুষগুলোর সাথে।
        এই মানুষটাকেই বলছিলাম, মাটি। এই সম্পর্কের উষ্ণতাই মাটি। এখানে একটা জীবনের সাথে আরেকটা জীবন কালের কাঁটায় উলের মত বোনা হয়ে যায়। একটা ছিঁড়তে গেলে আরেকটা ছিঁড়ে যায়। এর মূলতত্ত্ব মাধুর্য। আমার ক্ষমতা, ঐশ্বর্য না। আমার মনুষ্যত্বের মাধুর্য। সেই সার। সেই দিয়েই আমি একটা পরিবার গড়ি। তারা আমার অটোগ্রাফ নেয় না, আমার প্রশংসা করার সময়ও তাদের নেই। তারা রোগে-শোকে-সুখে-দুঃখে আমার শরীর মনের সাথে ছায়ার মত লেগে থাকে তাদের শরীর মন দিয়ে, তারাই আমার পরিবার। আমার মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা। সময় সেখানে হিসাবের বাইরে। সেখানেই আমি বাঁচি। আমি শ্বাস নিই। আমি হাত-পা ছড়িয়ে টানটান করে বলি, আহা, শান্তি! তাই কথা হল, ধূমকেতু পাই বা না পাই, এই মাটিটা না পেলে দাঁড়াই কোথা?

(শেষে একটা কথা না বললে হয় না। এই যে আমার এত লেখার শখ সেও কি বিখ্যাত হব বলে? এর বিচার কালের হাতেই থাক। আমি নিজে নাই বা করলাম।)