আমাদের অন্তর্জগতের নিজস্ব একটা সময়সারণী আছে নিশ্চয়ই। অনেক সময় দেখেছি খুব কাছাকাছি সময়ের লেখা, পড়লাম, ভালো লাগল, কি হয় তো তেমন ভালো লাগল না, মনের উপর বাতাসের মত বয়ে চলে গেল। আবার বহু প্রাচীন কোনো লেখার সঙ্গে আমার এই মুহূর্তের মনের জগতের সুরটা ধরা পড়ে গেল। আমায় ভাবালো। আমার সারাদিনের কাজের মধ্যে একটা শব্দ, কি একটা বাক্য, কি একটা অনুভব, গাছের পাতার শব্দের মত বেজেই চলেছে, বেজেই চলেছে। যা লেখা হয়েছে হয় তো বহু বছর আগে।
কয়েকদিন আগে, সন্ধ্যেতে নামল তুমুল ঝড়, সব অন্ধকার, এত বাজ পড়ছে ইনভার্টার ইত্যাদি বন্ধ করে দিতে হল। কিন্তু কি করব, ভীষণ পড়তে ইচ্ছা করছে কিছু একটা। বই তো কত। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের সাহায্যে এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে হাত পড়ল মলাট ছেঁড়া উপনিষদাবলীর উপর। বইটা নিলাম। টেবিলের উপর চায়ের ডিস উলটে, তার উপর মোমবাতি জ্বালালাম, পাতা উল্টাতে শুরু করলাম। পড়তে শুরু করলাম কেন উপনিষদ। এমনিই। মন এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ একটা শব্দে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আরেকবার পড়ো তো…. বলো আরেকবার…..
পড়লাম, সত্যমায়তনম্। সত্য তাঁহার নিবাসস্থল।
চোখ সরতে চাইলেও মন আর সরতে চাইল না। বলল, তুমি এবার বইটা বন্ধ করে চুপ করে বোসো। আমায় ছেড়ে দাও।
দিলাম। মোমবাতি নিভিয়ে চুপ করে বসলাম। বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টির শব্দ। মাথার মধ্যে, সারাটা শরীর দিয়ে বয়ে বয়ে যাচ্ছে শব্দ - সত্যমায়তনম্।
আমি নিজে কাকে দিতে পেরেছি সত্যাশ্রয়? চারদিকে মিথ্যা আর ছলনার দৌরাত্ম। ছাপা অক্ষরে, উচ্চারণে, গণমাধ্যমে, প্রচারে, আচারে, সম্পর্কে, ভালোবাসায়, আদরে - সর্বত্র মিথ্যার কি প্রবল আস্ফালন। আমার মধ্যেই বা কতটুকু সত্য? আমার ভালোবাসা, বিশ্বাস, চেষ্টা… আমার ভাষা, অনুভব… কোনটাকে আমি সত্যের আশ্রয়ে রাখতে চাইছি? আমার মন, আমার বুদ্ধি, যাবতীয় সব কিছু মিলে এই যে আমি, এর কতটাকে আমি সত্যাশ্রয়ী করে তুলতে পেরেছি?
আমার রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ল,
হেনকালে সত্যকাম---
কাছে আসি ঋষিপদে করিলা প্রণাম--
মেলিয়া উদার আঁখি রহিলা নীরবে।
আচার্য আশিষ করি শুধাইলা তবে,
"কী গোত্র তোমার সৌম্য, প্রিয়দরশন?'
তুলি শির কহিলা বালক, "ভগবন্,
নাহি জানি কী গোত্র আমার। পুছিলাম
জননীরে, কহিলেন তিনি, সত্যকাম,
বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে,
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে--
গোত্র তব নাহি জানি।'
শুনি সে বারতা
ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিলা কথা
মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল
পতঙ্গের মতো--সবে বিস্ময়বিকল,
কেহ বা হাসিল কেহ করিল ধিক্কার
লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার।
উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন,
বাহু মেলি বালকেরে করিয়া আলিঙ্গন
কহিলেন, "অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত।
তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।"
'ব্রাহ্মণ' কবিতার এ অংশ যতবার পড়েছি ততবার চোখে জল এসেছে। আজও এলো। কি সরল সত্য। জীবন কি সত্যই এই জটিল?
সত্য কি? এর সংজ্ঞা আমি বহুবার খুঁজেছি। পাইনি। আসলে খোঁজার আগেই জানি বলেই পাইনি। মানুষ হয়ে জন্মানোর মধ্যে যেটুকু মান, যেটুকু গৌরব সে সবটুকুই শুধু সত্যকে আশ্রয় করেই তো। খুঁজে পাওয়া তাত্ত্বিক সত্য নয়, সে তো মত, সে তো ব্যাখ্যা। মানুষ আজ অবধি যা খুঁজে পেয়েছে সবই তো মত আর ব্যাখ্যা। সত্য যখন নিজেকে মানুষের চেতনায় বোধে ধরা দিয়েছে, তখনই সে ঋত, সূত্র। সেই খোঁজাখুঁজির আগেই হৃদয়ে জাগা যে সত্য, তার আশ্রয়ে কতটুকু নিজেকে স্থির করতে পেরেছি? বাইরের সব ঝড়জল তো ওই আশ্রয়েই তরে যাওয়া যায়। সে অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকবার। কাল্পনিক বহু দেবদেবী যখন নিরুত্তর, জীবনের ভীষণ উথাল-পাতাল মুহূর্তে কে হাল ধরেছিল? নিজের ভিতরেই এই সত্যই তো! সত্যমায়তনম্।
ঝড় থামল। কারেন্ট এলো খানিকবাদে। আবার কাজের ছন্দে ফেরা। মন বলল, ও তো চেনা রাস্তা, তুমি এগোও আমি আসছি, একটু অবকাশ চাই, শব্দটার গভীরে বড় একটা কথা আছে, সেটাকে একবার স্পর্শ করে আসি।
বললাম, বেশ, তাই হোক। তোমার ছোঁয়াই আমারও ছোঁয়া। কিন্তু তুমি পাবে কি? সে নিজে না ধরা দিলে?
মন বলল, সে ডেকেছে বলেই তো ডাক কানে এসেছে…রাজার চিঠি রাজার হাতের ছোঁয়া নিয়েই তো আসে গো….