নিবেদিতা তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ - 'স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি' শেষ করছেন একটা প্রার্থনা দিয়ে, স্বামীজির এই জীবন্ত সত্তা যেন শুধু স্মরণীয় না হয়ে চেতনায় জ্বলন্ত জাগ্রত হয়ে অবস্থান করুক।
'কোনো একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মানো ভাল, কিন্তু তার গণ্ডীর মধ্যেই মৃত্যু হল অতি ভয়ঙ্কর।'...'চিত্তশুদ্ধি অর্থে নিঃস্বার্থপর হওয়া'...'নিঃস্বার্থপরতাই ঈশ্বর'...
এ কথাগুলো বলার আড়ালে যে মানুষটা, সে শুধু চিন্তাবিদ হলে আজ মন খারাপের প্রশ্ন থাকত না। সে মানুষটা রোগের চিকিৎসা করতে চাননি, চেয়েছেন রুগীর চিকিৎসা। সারা পৃথিবী জুড়ে ঝড়ের মত ঘুরে বেড়িয়ে শরীর যখন প্রায় ছিবড়ে হয়ে গেছে, ওঁর ভাষায় 'মুখ থেকে রক্ত ওঠা' পরিশ্রমে, তখন সে বেলুড় মঠে ফিরতে চাইছেন বিশ্রামের জন্য, আর কিসের জন্য? না বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা জলের ধারার সাথে বেয়ে বেয়ে চলে যাবে, তা দেখার জন্য। খুব নগন্য কথা, জানি। তবু আজকের দিনে ভারী কথাগুলো বেরোতে চায় না যে।
ভালোবাসার প্রকৃত রূপটা ওর লেখায় পড়ে জেনেছিলাম। বললেন প্রেম ত্রিকোণাত্মক। এক, নিঃস্বার্থপরতা। দুই, বাসনাহীনতা, কারণ প্রেম নিজেই নিজের লক্ষ্য, পরিপূর্ণতা। ভালোবাসা আনন্দময়। যদি তাতে যন্ত্রণা, শোক, বিষাদ আসে তবে জেনো, তা স্বার্থপরতা, ইন্দ্রিয়পরতা, প্রেম নয়। তিন, ভয়হীনতা। কেমন না, যে মহিলা রাস্তায় একটা কুকুর দেখলে পাশের বাড়িতে ঢুকে পড়েন, তিনি তার সন্তানের জন্য সিংহের মুখোমুখি দাঁড়াতেও অকুতোভয়।
'সম্পদে-বিপদে, ঐশ্বর্যে-দারিদ্র্যে, রোগে-স্বাস্থ্যে - মৃত্যু পর্যন্ত যেন বিচ্ছেদ না হই' নিবেদিতার মুখে এই কথাগুলো শুনে সারদাদেবী আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠেন, বারবার আবৃত্তি করতে থাকেন, 'আহা কি ধর্মের কথা গো!' স্বামীজি পরবর্তীকালে বিবাহের এই প্রতিশ্রুতির কথা বলতে গিয়ে বলেন, 'স্বাধীনতা শুধু কিছু করার অধিকার নয়, বরং কিছু করার ইচ্ছাকে দমন করার অধিকারকেও বোঝায়!' এক বৃদ্ধ দম্পতির কথা বলেন, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর একসাথে থাকার পর তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। বৃদ্ধ প্রথম রাতে একা শুতে যাওয়ার বলে ওঠেন, 'দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর আমি শুতে যাওয়ার আগে ওকে চুমু খেয়ে শুতে গেছি, হা ঈশ্বর আজ আমি শুতে যাব কি করে?' এ ঘটনা বলতে বলতে স্বামীজি উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকেন, এই হল নিষ্ঠা, এই হল ধর্ম, এই তো মুক্তি!
হ্যাঁ একজন সন্ন্যাসীই একথা বলছেন। যাকে আমরা 'হয় এটা' 'নয় ওটা' চিন্তাধারা বলি (black and white thinking) স্বামীজির চিন্তায় সে ধারা নেই। তিনি সব সময়ই যে কোনো আদর্শের দুটি বিপরীতপ্রান্তের তুল্যমূল্য বিচার করে তাদের মিলনস্থল চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হতেন। তাই বলতে পারেন, সব ধর্মের মূলেই একটা স্বার্থপরতার ভাব থাকে, তা না হলে কোনো ধর্মই তৈরি হত না।
এক এক সময় মনে হয়, ওনার গায়ে ওই গেরুয়া বস্ত্রটা না থাকলে কি ভালই না হত! যদিও জানি সেদিনের প্রয়োজনের তাগিদে তার দরকার ছিল। তবে আজ নেই। তাঁকে শুধু হিন্দু সন্ন্যাসী ভাবা মানে আইনস্টাইনকে, বিঠোভেনকে শুধুই জার্মান, অথবা শেক্সপীয়ার কিম্বা টলস্টয়কে শুধুই ইংরেজ বা রাশিয়ান ভাবার সামিল। ভাবলে, ঠকব আমরাই। ক্ষতি আমাদেরই। তিনি নিজেই বলছেন, তিনি A VOICE WITHOUT FORM, নৈর্ব্যক্তিক কণ্ঠস্বর। সে স্বর যতই কানের ভিতর ধরে মরমে পশে ততই মঙ্গল। ব্যক্তির মঙ্গল, দশের মঙ্গল, দেশের মঙ্গল, তথা বিশ্বের মঙ্গল। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রোমা রোঁলা তাই স্বামীজির জীবনীকে লিখতে গিয়ে বলছেন... GOSPEL OF MANKIND.....মানব আত্মার বাণী।
( আজ ৪ঠা জুলাই, ওঁর মহাপ্রয়াণ দিবস)