সৌরভ ভট্টাচার্য
19 April 2019
বিধাতা উপদেশের ব্যবস্থা করেননি, অভিজ্ঞতার দরজা খুলে রেখেছেন। ভেবেছিলাম যত বয়েস বাড়বে মনের মধ্যে তত একজন স্পষ্ট গুরুমশায়ের আসন দেখতে পাব। যে প্রতি পদক্ষেপে আমায় সদুপদেশ দেবে, আমার হতে যাওয়া ভুল আটকাবে আমার হাত ধরে। কিন্তু হল কই? মনের মধ্যে না দেখি গুরুমশায়কে, না মোড়লকে।
দায়িত্ববোধ বিবেকবোধের চাইতে অনেক বেশি দরকার। যেদিন একজন জলজ্যান্ত মানুষকে চিতায় তুলেছি ঢাকঢোল বাজিয়ে, কিম্বা আজও ছেলের গলায় ক'গাছা সুতো ঝোলানোর উৎসবে লোক খাইয়ে নিজের কাল্পনিক 'উচ্চবর্ণ'-এর উল্লাসে মাতছি --- দুই-ই ভয়ানক। এতে আমাদের বিবেকে লাগে না, কারণ বিবেক গড়তে সমাজ, শাস্ত্র ইত্যাদি অনেক মালমশলা আছে। কিন্তু মানবিকতার দায়িত্ববোধ জন্মালে বোঝা যায়, যা করছি তা নিতান্ত অন্ধ অমানবিক একটা প্রথাকে অনুসরণ। এতে সমাজের কিছু মঙ্গল নেই, খানিক উত্তেজনা, আমোদপ্রমোদ ছাড়া। এই দায়িত্ববোধ মুক্তচিন্তার অভ্যাস থেকে জন্মায়, যে চিন্তার দায়ভার নিজেকেই নিতে হয়।
আমি যেদিন পৈতে ছেড়েছিলুম সেদিন আমি মনের মধ্যে একটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলুম। যেদিন প্রথাগত ধর্মের অভ্যাস ছেড়েছি সেদিনও তাই। ঈশ্বর আছেন কি নেই, এ প্রশ্ন অমূলক। আমাদের কল্পিত ঈশ্বর থেকেও যে এদ্দিন গোটা বিশ্বের খুব একটা উপকার হয়নি সে চোখ মেললেই বোঝা যায়। তবু যদি তিনি থেকে থাকেন, তিনি এতটা দুর্বল নন নিশ্চয়ই যে মানুষের বানানো চিত্রনাট্যে অভিনয় করতে চাইবেন। আমি 'মিস্টিক' কি জিনিস জানি না। কারণ চোখে দেখিনি। ভক্ত দেখেছি মেলা। যত দেখেছি ভক্তির উপর ভক্তি কমেছে তত, তাদের দ্বিচারণে। মুষ্টিমেয় ভক্ত যাদের নীরব ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে নিজের বিশ্বাসের বিজ্ঞাপন নেই, এমন মানুষ নিয়ে কিছু বলার নেই, তারা শ্রদ্ধেয়। কিন্তু দলতান্ত্রিক ভক্তমণ্ডলীর এমন সব দ্বিচারণ দেখেছি যে অবাক হয়েছি। তাদের ভাষার সাথে ভাব মেলে না, ভাবের সাথে কর্ম মেলে না। শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়, "আমরা বনাম তোমরা"। এই নিয়ে অবশ্যই তর্ক হতে পারে, কিন্তু তর্কে অপযুক্তি আর ছদ্মযুক্তির আতিশয্যে আসল কথাটা মাঠে মারা যায় যে আদতে আমরা আমাদের ছাড়া কিছু বুঝি না, বা তা বোঝা সম্ভবও নয়। ঈশ্বর ইত্যাদি ইন্দ্রিয়-অতীত বস্তু নিয়ে ইন্দ্রিয়জগতে মারামারি করা যায় না। যা বুঝি না, যা জানি না, তাকে কেবল মানি বলে দাঁড় করিয়ে রাখলে নিজেকেও দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। স্থবির হতে হয়। সেই স্থবিরতাকে সিদ্ধি বলে বিশ্বাস করাতে গেলে হয় চোখ রাঙাতে হয়, নইলে ভান করতে হয়। অগত্যা সত্যভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয় না।
যে কথাটা শুরুতে বলতে চাইলাম। অর্থাৎ মনের মধ্যে কোনো গুরুকে পেলাম না। পেলাম সত্যকে নিজের বোধের আলোয় অনুভব করার সাহস। মাঝে মাঝে মন দুর্বল হয়েছে। দলের মধ্যে আশ্রয় চাইতেও গেছি, যাতে কোনো রেডিমেড সত্যের সাথে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। ঠকেছি। নিজে সত্য না হলে সত্যের সন্ধান মেলে না, এ হাড়ে হাড়ে অনুভব করে ফিরে এসেছি। কিন্তু নিজে সত্য হব বললেই তো হওয়া যায় না। এত ভেজাল মিশে যে কোনটা আসল আমি খুঁজে পাওয়াই দায়। তবে উপায়? উপায় একটাই, তবু চলতে থাকা। কোন GPS নেই, ম্যাপ নেই। সম্বল বলতে একটাই, আমি যতটা খাঁটি, আমার প্রাপ্য আলোও সামনে ততটাই। নিজের খিদে অনুযায়ী ভাত নিজেকেই বেড়ে নিতে হবে, অন্যের খাওয়া অনুকরণ করলে আখেরে হয় আধপেটা, নয় আইঢাই।
তবে কি কেউ পথ দেখাতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। তবে পথ নেই যেখানে সেখানে পথ দেখাবে কি? প্রতিদিন আমার হয়ে ওঠাটাকে যদি মিথ্যা মিথ্যা 'চলা' নাম দিই, তবেই পথের কথা আসে। আর পথের কথা এলেই অমনি পথপ্রদর্শকের প্রসঙ্গ, আর সে প্রসঙ্গ এলেই ফাঁকি আর ভণ্ডামির আয়োজন। কিন্তু যেখানে প্রতিদিন হয়ে ওঠার কথা, সেখানে আমায় কেউ হইয়ে দিতে পারে কি করে? আমায় অনুপ্রাণিত করতে পারে কেউ অবশ্যই, কিন্তু সে তো বাইরে থেকে তাড়া দেওয়া নয়, সে তো ভিতরের তাগিদ। আর আমার তার প্রতি শ্রদ্ধাও সেই অনুপ্রেণায় সাড়া দিয়ে ক্রমে ভিতরের দিকে হয়ে ওঠায়। অনুভবের এত বিজ্ঞাপন কেন তবে? নিজেকে নিয়ে এত মার্কেটিং-ই বা কেন তবে? আমার শরীরের প্রতিটি কোষ থেকে শুরু করে আমার ব্যক্তিত্বটি পর্যন্ত পরিবর্তনশীল একটা সত্তা। তার ছন্দ বাঁধতে গেলেই তাকে বিনষ্ট করা। শুধু দেখতে হবে তার গতিটা যেন থেমে না যায়। মনে রাখতে হবে আমি চলছি না, আমি হচ্ছি। কি হচ্ছি? আরো স্পষ্ট, আরো স্বচ্ছ। কার কাছে? জগতের বানানো ঈশ্বরের কাছে নয়, কোনো নীতির কাছে নয়, শুধুমাত্র নিজের ভিতর যে প্রাণের স্পন্দন চলছে তার কাছে। এইতেই আনন্দ। সর্বোচ্চ আনন্দ। এর বাইরে যা কিছু শুধুই পোশাকি, তার আবর্জনা কালের স্রোতে অনেক জমেছে, এবার একান্তভাবেই ত্যাগ না করলেই নয়।