আকাশের নক্ষত্র, আত্মার নৈতিকতা আর মস্তিষ্কের গোপন খেলা -
মহান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের সমাধিতে দুটি বাক্য খোদাই করা আছে যা তাকে সারা জীবন বিস্মিত করেছিল: "আমার উপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ, আর আমার ভিতরে নৈতিকতার বিধান।" কী গভীর! আজ যদি কান্ট বেঁচে থাকতেন, হয়তো তিনি কগনিটিভ সায়েন্স আর অ্যাস্ট্রোনমির গভীরে ডুব দিতেন। বার্ট্রান্ড রাসেলও একবার বলেছিলেন, যদি আবার ছাত্র হওয়ার সুযোগ পেতেন, তবে দর্শনের বদলে পদার্থবিজ্ঞানই তাঁর বিষয় হতো।
এগুলো নিছকই কল্পনা। কিন্তু এই কল্পনা কি কম শক্তিশালী? আমাদের মস্তিষ্কের জটিল জালের মধ্যেই তো কল্পনার জন্ম, যা আমাদের বর্তমানের বেড়াজাল পেরিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে উঁকি দিতে সাহায্য করে। কল্পনার আয়নাতেই আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, আর অতীতের ভুলগুলো থেকে শিখি।
ডোপামিনের বহুমুখী রহস্য: তাৎক্ষণিক সুখ বনাম দীর্ঘমেয়াদী তৃপ্তি -
সম্প্রতি ডোপামিন নিয়ে একটি fascinating আলোচনা পড়লাম। ডোপামিন কী? সহজ কথায়, এটি একটি নিউরোকেমিক্যাল যা আমাদের সুখ, পুরস্কার এবং অনুপ্রেরণার অনুভূতি দেয়। যখন আমরা কোনো কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করি, ডোপামিন আমাদের মস্তিষ্কে একটি 'পুরস্কার' হিসেবে কাজ করে, আমাদের উৎসাহিত করে এবং বলে, "আবার করো!" আবার, যখন আমরা ব্যর্থ হই, তখন এটি 'প্রেডিকশন এরর' (অনুমানের ভুল) তৈরি করে, যা আমাদের সেই কাজটি এড়িয়ে চলতে শেখায়।
কিন্তু ডোপামিন এত সরল নয়! বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডোপামিন 'মাল্টিপল টাইমস্কেল'-এ কাজ করে। অর্থাৎ, এটি শুধু তাৎক্ষণিক সুখের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের বড় সুফল পাওয়ার জন্যও আমাদের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। যে কাজ হয়তো এখন আনন্দ দিচ্ছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে বড় ফল বয়ে আনবে, সেই কাজ করার জন্য ডোপামিন আমাদের ধৈর্য ধরতে শেখায়। এই কারণেই মানুষ ত্যাগ স্বীকার করে, কৃচ্ছ্রসাধন করে—কারণ ডোপামিন তাকে ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত সুখের ছবি দেখায়। আমাদের মস্তিষ্ক যে সুদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকে, তার পেছনেও ডোপামিনের এই সূক্ষ্ম কৌশল কাজ করে! তাৎক্ষণিক সুখ আর দীর্ঘমেয়াদী সুখের মধ্যে বিবেচনার টানাপোড়েন।
উপনিষদে বহুকাল আগে দুটো পথের কথা বলছে - শ্রেয় আর প্রেয়ের পথ। এক তাৎক্ষণিক সুখের পথ, যা প্রেয়। আরেক সুচিন্তিত দীর্ঘস্থায়ী সুখের বিধান, যা শ্রেয়। এর মূলে কি ডোপামিনেরই খেলা?
মহাবিশ্বের টানাপোড়েন, মানুষের চিত্তের প্রতিচ্ছবি -
মানুষের চিত্তে এই কেন্দ্রাভিমুখী (Centripetal) আর কেন্দ্রাতিগ (Centrifugal) বলের টানাপোড়েন চিরন্তন। কোনটা সঠিক, তা সে কোনোদিন সম্পূর্ণ জানতে পারে না। তার মস্তিষ্কে যতই 'মাল্টিপল টাইমস্কেল' থাকুক না কেন, সে আসলে অজানার তিমিরে নিমজ্জিত। এই বিশাল অজানার মধ্যে তার বোধের আলো কতটুকুই বা পথ দেখায়?
একবার মহাজগতের দিকে তাকান! সেখানে আছে ডার্ক ম্যাটার, যা অদৃশ্য হলেও মহাবিশ্বের ২৭% জুড়ে আছে, গতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং গ্রহ-নক্ষত্রকে একত্রে ধরে রেখেছে। এর বিপরীতে আছে ডার্ক এনার্জি, যা ৬৮% জুড়ে আছে এবং সবকিছুকে কেন্দ্রের বাইরে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের চিত্তের মতোই এই মহাবিশ্বও এক অনন্ত টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। আমরা ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জিকে জানি, অথচ তাদের স্বরূপ কী, তা জানি না!
অজানার পথে দার্শনিকের অবিচল যাত্রা -
বিশ্বজুড়ে চলছে এক তাণ্ডব, যেন নটরাজের প্রলয়লীলা। কেন? উত্তর আমাদের অজানা। মনে হয় যেন সব শুভশক্তি অশুভের ইন্দ্রজালে আটকা পড়ে আছে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা আছে, তবুও হচ্ছে না। আবার সবকিছু স্থিতিতে আসার সম্ভাবনাও আছে, তবুও হচ্ছে না।
দার্শনিক তার বোধের কল্পনায় তথ্যকে হয়তো স্পষ্ট দেখতে পায় না, কিন্তু কোথাও যেন একটা অস্পষ্ট ছাঁচ দেখতে পায়—ত্রুটিপূর্ণ হলেও সে হাল ছাড়ে না। সে এই টানাপোড়েনকে স্তব্ধ করে শান্তি খোঁজে না, বরং এর মধ্যেই এক সাম্যাবস্থা চায়। তার আসল টানাপোড়েন হলো জানা আর অজানার মধ্যে। তার আকুতি, তার কান্না, তার বিস্ময়, তার সবটুকু জানার সাধ—এসবই তাকে চালিত করে। সে হতাশায় ডুবে যায় না, অপেক্ষা করে, ধৈর্য ধরে। এক বালুকণাকে সে যেমন গভীরে পর্যবেক্ষণ করে, তেমনই মহাকাশের নক্ষত্রমণ্ডলীর সভায়ও সে আসন পাতে—জানতে চায়, তারা কী বলছে।