সৌরভ ভট্টাচার্য
26 January 2016
২৫শে জানুয়ারী সন্ধ্যেবেলা। কয়েকজন উঠতি বয়সের ছেলে ২৬শে জানুয়ারীর
ছুটির উদযাপন করার প্ল্যান করছে কানে এলো। শীতের কুয়াশায় ঢাকা মাঠ। ছেলেগুলোকে
স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছে না। গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছি অনেকেই কৈশোরের দোড়গোড়ায়
হবে। আলোচনার মূলকথা যা বুঝলাম – মদের মোট টাকাটা উঠছে না। আমি
অস্বস্তিতে পড়ছি, তবু জায়গাটা ছাড়তে পারছি না, কারণ একজন বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। ভাষা অশালীন। তবে কান অভ্যস্ত হয়ে
গেছে। হঠাৎ হুল্লোড় শুনে বুঝলাম সমস্যা মিটে গেছে। হইহই করে সব আমার পাশ দিয়ে
বেরিয়ে গেল। মাফলারে, টুপিতে, পুলওভারে
আদ্যোপান্ত ঢাকা। বড়জোর ক্লাস টুয়েলভ হবে ওদের বরিষ্ঠতম সদস্যের।
বন্ধু ফোনে জানাল সে আসছে না। হাঁটতে শুরু করলাম বাড়ির দিকে। মোড়ে
মোড়ে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের জন্য বাঁশ পোঁতা। তাতে পতাকা উত্তোলন হবে। কয়েকটা
জায়গায় মাঠে আগুন জ্বলছে। সারারাতব্যাপী পিকনিক। কাল প্রজাতন্ত্র দিবস – ছুটির দিন। আমোদের গন্ধ। এই জিনিসটা খাওয়ার চল কি আগের থেকে বেড়ে গেছে?
মনে মনে নিজেকে কনজারভেটিভ বলে দুষলাম। তবু মনে হল, বেড়েছে কি? ছাত্রছাত্রী মহলে ইদানীং এত বেশি শুনি,
ধন্দ লাগে। উড়িষ্যায় দেখেছি আদিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন উৎসবে কিশোর
কিশোরী থেকে বুড়োবুড়ী অবধি প্রমত্ত হয়ে উঠেছে। খুব আধুনিক হয়েছি কি তবে? জানি না।
মনটা কেমন লাগতে লাগল। কিশোর মুখগুলো রাস্তায় বেশি করে চোখে পড়তে
লাগল। এরা কাকে ঠিক বলে জানে? কি জিনিসটা বড় এদের কাছে?
কোনো স্বপ্ন দেখে কি? নাকি বড়দের মুখে,
'এ দেশের কিছু হবে না... সব উৎসন্নে গেছে' গোছের
মনোভাব এদেরও শিকড়ে দানা বাঁধছে? এরা কি বিশ্বাস করে তারা
ভাল কিছু করতে পারে... বড় কিছু করতে পারে? ওদের স্বপ্নকে
আগলে রাখার মত শক্ত হাত আছে ওদের আশেপাশে? মোবাইল ভরতি
পর্ণোগ্রাফি... শিক্ষকবেশী ব্যবসায়ী... অতি-উচ্চাকাঙ্খী উদভ্রান্ত বাবা মা...
ঘোরাচ্ছন্ন বন্ধু-বান্ধব... লক্ষহীন অস্থির সংস্কৃতি... ইত্যাদির ঘূর্ণী কাটিয়ে কে
ওদের স্বপ্নের মাঝি হবে? কে হাল ধরবে?
এইসব মাথার মধ্যে জট পাকাচ্ছে। হাঁটছি। হঠাৎ কানে এলো, কে কাকে বলছে, “বাবা পড়াশোনাটা ঠিক করে কর। আমাদের
মত গরীবের এই পড়াশোনা ছাড়া কি পুঁজি বল?”
পিছন ফিরে তাকালাম। সেলুনে একজন মধ্যবয়সী মানুষ, যিনি নাপিত, তিনি তার কিশোর বয়সী এক খদ্দেরের মাথায়
কিছু একটা পেশাগত কাজ করতে করতে খুব আবেগ আর আন্তরিকতা মিশিয়ে কথাগুলো বলছেন। আমি
খানিক থামলাম। ভাল করে খেয়াল করলাম সে সেলুনের মালিককে। এরা নতুন ভারত গড়তে পারেন
না? আমরা দেশ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে অনেকদিন তো
দেশ চালালাম। ওরা কি ভাবেন খোঁজ নিয়েছি? ওরা কিভাবে ভাবেন?
জীবন কি শিখিয়েছে ওদের যে এত উতলা ছেলেমেয়েদেরকে পড়াশোনা শেখাবার
জন্য – এ উদাহরণ তো ইনি একা নন!
মহাত্মা গান্ধী বুদ্ধিজীবি মানুষদেরও মাঠে ঘাটে, কায়িক পরিশ্রমের কাজের কথা বলতেন (প্রবন্ধের শেষে দ্রষ্টব্য)। একজন
সম্পূর্ণ মানুষের বিকাশে প্রাথমিক শারীরিক শ্রমের গুরুত্ব খুব দিতেন, যা তলস্তয় ফার্মে করেছিলেন। ওনার পায়খানা পরিস্কার করার উদ্যোগের কথাও ওর
জীবনী পাঠক মাত্রেই জানেন।
এ সত্য। জীবনের সব শিক্ষা বই দিতে পারে না, সিলেবাস
দিতে পারে না। আবার বিনা প্রথাগত শিক্ষাতেও সে আলো পূর্ণ মাত্রায় জ্বলবে না। এই
দুই শিক্ষার মেলবন্ধন চাই। শুধু আই আই টি, এ আই এম এস
ইত্যাদির হিসাবে কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন হয় কি? না বোধহয়।
যে গ্রামে, যে শহরের মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারায় শরীর ও মনের
মেলবন্ধন যত স্বচ্ছ, সুস্থ, সেখানকার
জীবনের মান তত উন্নত। সেখানে দুর্নীতি, ব্যাধির প্রকোপ তত
কম। সুস্থ সবল মানসিকতার অধিকারী মানুষকে অসৎ করার চেয়ে দুর্বলচিত্ত, দুর্বল দেহ মানুষকে অসৎ করা অনেকগুণ সোজা। অন্তত অসৎ কাজে চুপ করিয়ে রাখার
মতন মহান কাজে তারা সর্বদা সহজলভ্য। আর যার গলায় জোর আছে, শরীরে
জোর আছে, সে চেঁচাবেই। সৎ হবে ভেবে না, প্রকৃতির নিয়মানুসারেই। অসুস্থতা নেই বলছিনে। কিন্তু কোনো জায়গার বেশিরভাগ
মানুষ অসুস্থ হলে সেখানকার জলহাওয়া পরীক্ষা করা উচিৎ।
আমাদের মুলস্রোতে সমাজের সবস্তরের মানুষকে হাত লাগাবার, মতামত দেবার অধিকার দিতে হবে। প্রথাগত শিক্ষাকে, হাতেকলমে
শেখা মানুষদের সাথে যুক্ত হতে হবে। আবার বিপরীতটাও সম্ভব করতে হবে। শুধু প্রকল্প
চালু করে না। উদ্যোগী হয়ে সেগুলোকে ফলপ্রসূ করে তুলতে। তার সাথে, মাথার সাথে শারীরিক শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হই এমন শিক্ষাধারাও চালু
করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ শুধু কলম না, হালও ধরেছিলেন। সে ছবিও
দুষ্প্রাপ্য না।
দেখাই যাক না ভেবে।
======================
মহাত্মাজীর লেখা থেকে সংগৃহীতঃ
-------------------------------
ঐশ্বরিক নিয়ম
--------------
ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন যাতে সে উদরান্নের জন্য কাজ করে।
বলেছিলেন, যারা কাজ না করে খায়, তারা
তস্কর।
আমরা যেন ঘাম ঝরিয়ে উদরান্নের সংস্থান করি। এই হল মহান প্রকৃতির
অভিপ্রায়। এতএব, যে যতক্ষণ অলস হয়ে বসে থাকে, সে ততক্ষণই তার প্রতিবেশীদের কাছে বোঝা। ওরকম করার অর্থই হচ্ছে অহিংসার
প্রথম পাঠটির বিরোধিতা করা। প্রতিবেশীর জন্য অন্যের সুসঙ্গত ও নির্দিষ্ট বিবেচনা
না থাকলে অহিংসা অর্থহীন, এবং এই প্রাথমিক শর্তটি অলস
ব্যক্তি পূরণ করতে পারে না।
রুটির জন্য শ্রম প্রসঙ্গে তলস্তয়ের রচনা পড়ে প্রথম আমি ঐ নিয়মটি
উপলব্ধি করি যে, বাঁচতে হলে মানুষকে কাজ করতেই হবে। কিন্তু
তার আগেও রাসকিনের 'আনটু দিস লাস্ট' পড়ে
শ্রমের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জাগরুক হয়েছিল। ত. ম. বন্দারেভ নামক জনৈক রুশী লেখক
প্রথমে এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেন যে, মানুষের উচিত
স্বহস্তে পরিশ্রম করে নিজের রুটি জোগাড় করা। বিষয়টি তলস্তয় গ্রহণ করলেন এবং ব্যাপক
প্রচার করলেন। আমার মতে, 'গীতা'র তৃতীয়
অধ্যায়েও এই একই নীতি বিধৃত হয়েছে। যেখানে বলা আছে যে, উৎসর্গ
না করে যে ব্যক্তি খাদ্য গ্রহণ করে সে চুরি করা খাদ্য খায়। এখানে উৎসর্গের একমাত্র
অর্থ হতে পারে রুটির জন্য শ্রম।
যুক্তির নিয়ম
------------
যুক্তির সাহায্য নিলেও ওই একই সিদ্ধান্তে আসতে হয়। যে কায়িক পরিশ্রম
করে না, খাওয়ার অধিকার তার আসবে কোথা থেকে? বাইবেলে আছে, 'নিজের কপালের ঘামের বিনিময়ে তুমি
তোমার রুটি খাবে'। একজন লক্ষপতিও যদি সারাদিন বিছানায় গড়িয়ে
কাটায় এবং এমনকি তাকে খাইয়েও দিতে হয়, তাহলে সে-ও বেশিদিন
ওইভাবে কাটাতে পারবে না, অচিরাৎ নিজের জীবন নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে
উঠবে। সে, এতএব ব্যায়াম করে ক্ষিধে তৈরী করে, নিজের হাতে খায়।
এখন, কী গরিব, কী ধনী
সকলকেই যদি কোনও-না-কোনওভাবে ওই ব্যায়াম করতেই হয় তাহলে তা কেন উৎপাদনশীল বা রুটির
জন্য শ্রমের রূপ নেবে না? কেউ চাষীকে প্রাণায়াম বা পেশীর
ব্যায়াম করতে বলে না। আর মানবজাতির নয় দশমাংশ জমি চাষ ক'রেই
প্রাণধারণ করে। পৃথিবী আরও কত আনন্দময়, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও
আরোও শান্তিপূর্ণ হতো যদি ওই বাকি এক দশমাংশ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের উদাহরণ অনুসরণ
করত, অন্তত তাদের খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমটুকু করত।