Skip to main content

যদি বৃন্তের সৌন্দর্য না বুঝি তবে পাপড়ির সৌন্দর্যকে বুঝি কি করে? ফুল মানে কি কেবল পাপড়ির রঙ, রূপ, সজ্জা? 

     ওই যে মালা গাঁথা হচ্ছে, বৃন্তের বুকের মধ্যে সূঁচ বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে, সুতো পরিয়ে। বৃন্ত নির্বিকার। বৃন্ত জানে মালা গাঁথতে হলে এ তাকে সহ্য করতেই হবে, পাপড়ি সহ্য করতে পারবে না, ছিঁড়ে যাবে সে! 

     মানুষের মধ্যেও দুটো সৌন্দর্য থাকে। পাপড়ির আর বৃন্তের। পাপড়ি বাইরের। সেখানে কখনও কখনও নকল জিনিসও চালিয়ে দেওয়া যায়। বৃন্ত অন্তরের। সেখানে নকল চলে না। সেখানে ফাঁকি চলে না। মানুষে মানুষে এক হতে হলে বৃন্তের মতই হৃদয়কে সূঁচবিদ্ধ হতে হয়, অন্যকে নিজের মধ্যে অনুভব করে। তবেই মালা গাঁথা হতে পারে। বাইরে থেকে দল গড়ে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করা যেতে পারে, এক করা যায় কি? 

     আজ তেহেরানে মানুষ যে ভাবে রাস্তায় এসে নেমেছে, প্রাণ দিচ্ছে, তার কারণ 'মাথা ঢাকব না' তো নয়। তার কারণ মনুষ্যত্বের অপমান হয়েছে বলে। মানুষ সব কিছু সহ্য করে নেয়, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মনুষ্যত্বের অপমান সে সহ্য করে নেয় না। গর্জে সে উঠবেই। কোনো লোভ, কোনো ক্লীব নিরাপত্তা, কোনো সুখের ফাঁদে মানুষের মনুষ্যত্বকে অপমান করে আটকে রাখা যায় না। তাই সে তার ধর্ম নিয়ে মত বদলেছে, সমাজ নিয়ে মত বদলেছে, রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি সব নিয়ে মত বদলেছে। যে নীতি মনুষ্যত্ববোধের সব চাইতে কাছে তাকেই নিতে চেয়েছে। প্রকাশ করতে চেয়েছে।

     কিন্তু বাস্তব জীবনে সে কাজ সহজ নয়। অনেক বাধা। আর বাধা আছে বলেই লড়াইও আছে। আর লড়াই আছে বলেই মনুষ্যত্ববোধের মূল্যকেও যুগে যুগে নতুন করে অর্জন করতে হয়েছে। 

     আজ যে 'ভারত জোড়ো' আন্দোলন হচ্ছে সেখানে ভঙ্গী আছে, কিন্তু তাগিদ নেই। কারণ আসল কথাটা ভারতকে জোড়া তো নয়, নিজের দলের পায়ের নীচে মাটি খোঁজা। কিন্তু এই নকল ভঙ্গীতে কি আসল বস্তু লাভ হয়? দলের নিজের ভিতরের সমস্যার কারণ না খুঁজে তাকে বাইরে খোঁজা অনেকটা নাসিরুদ্দিনের গল্পের সেই চাবি খোঁজার গল্পের মত। যেখানে নাসিরুদ্দিন উঠানে বেশি আলো আছে বলে চাবি খুঁজছে, ঘরে না খুঁজে, যেখানেই চাবিটা হারিয়েছে আসলে, কারণ ঘরটা অন্ধকার।

     রামকৃষ্ণদেবের গল্পে আছে, ছেলে মা-কে বলছে, মা আমায় হাগা পেলে তুলে দিও। মা বলছেন, বাবা হাগা যখন পাবে ওই হাগাই তোমায় ঠেলে তুলবে, আমায় ডাকতে হবে না। 

     ব্যক্তি হোক, দল হোক, দেশ হোক --- মূল একটাই, মনুষ্যত্বের বোধ। তার প্রকাশে উগ্রতা নেই। সৌন্দর্য আছে। সে সৌন্দর্য রঙের না। সংযমের। বৃন্তের সৌন্দর্য। বৃন্তই ঠিক করে পাপড়ির প্রকাশের পরিধি। বৃন্তই জানান দেয়, পাপড়ি ঝরে গেলেও সে আছে। মূলের সঙ্গে যুক্ত আছে সে।

     আমরা যখন সত্যিই অনুভব করব আমার কাজে, আমার ব্যবহারে, আমার নিষ্ক্রিয়তায় মনুষ্যত্বের অপমান হচ্ছে তখন আমি আপনিই জেগে উঠব। সভাসমাবেশ করে আমায় জাগাতে হবে না। ব্যক্তি আমি না জাগলে, না সতর্ক হলে ভাঙচুর করে, পথঘাট আটকে আদতে কিচ্ছু হবে না। তখন সেগুলো শুধুই হট্টমেলা। আর মনুষ্যত্ব জাগলে একা মানুষই যে হাজার মানুষের সমান তার সাক্ষীও ইতিহাস হয়েছে বারবার। সে রাস্তায় একা নামলেই হাজার একটা মানুষ তার সঙ্গে এসে দাঁড়ায়। 

     মনুষ্যত্ব বনাম লোভ, এই তো ইতিহাসের সার। চরিত্রগুলো বদলে বদলে গেছে বারবার দুই পক্ষেরই। আমাদের শুধু ঠিক করে নিতে হয় আমরা কোনো পক্ষ নেব। লোভের রাস্তায় পাপড়ি জড়ো করি, আর মনুষ্যত্বের রাস্তায় বৃন্তের যত্ন নিই। প্রথমটায় সুখ, দ্বিতীয়টায় আনন্দ। 

     আনন্দ আত্মিক, তার কোনো প্রতিপক্ষ নেই। তাই ফেডেরারের বিদায়ে নাদাল কেঁদে ভাসায়। আনন্দের প্রতিপক্ষ নেই বলেই সে প্রতিশোধ না চায় না, ন্যায় চায়। মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতে। কোনো এক বিশেষ জজের হাতে সে ভার না দিয়ে, রাতদিন তাকে স্তুতি না করে, নিজের চারপাশটা ভালো করে দেখে, সেখান থেকেই কাজটা শুরু না করলে অবশেষে সব কথাতেই শেষ হবে। 

     বৃন্তে প্রতিষ্ঠ হই। পাপড়ি আপনিই জাগবে। না জাগলেও ক্ষতি নেই। পরের প্রজন্মের হাতে যেন সুস্থ ক'টা বৃন্ত অন্তত দিয়ে যেতে পারি, নকল পাপড়ি না ধরিয়ে। তারা ক্ষমা করবে না।