সৌরভ ভট্টাচার্য
18 March 2020
কোরোনা ভাইরাস অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হয় তালা ঝুলিয়েছে, নয় বাঁধন এনেছে – এই নিয়ে নানা পোস্ট দেখছি – কেউ ব্যঙ্গ করছেন, কেউ মজা করছেন, কেউ প্রবল পরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে অমুক মঠ, তমুক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হয়ে তাদের সমর্থনে যুক্তির পর যুক্তি সাজাচ্ছেন।
এখন কথা হল, এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? মানুষ যে কারণে একসাথে বসে খেলা দেখা, একসাথে বসে ভোজ খাওয়া, মজলিস বন্ধ রেখেছে, সেইভাবেই একসাথে বসে ধর্মীয় কাজ বন্ধ রেখেছে।
এখানে যুক্তি হল, তবে ঈশ্বরের রক্ষাকর্তা রূপটি কই?
এখানে প্রথম কথাই হল, ধর্মীয় সংগঠন আর ঈশ্বরকে এক করে দেখা। প্রথমেই বুঝতে হবে ঈশ্বর কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে থাকেন না। সেখানে কিছু উচ্চমার্গের মানুষ, সাধারণ মানুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে, সাধারণ মানুষের উদ্ধারের জন্য থাকেন। সাধারণ মানুষ তাদের অর্থ, ভক্তি, যুক্তিবোধ – নিজের নিরাপত্তার আশায়, পরকালের পথ সুগমের জন্য, অভ্যাসবশত ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে দান করে থাকেন সেখানে স্বেচ্ছায়। সেখানে মানুষের শুদ্ধতার হায়ারার্কি থাকে, মানে স্তরবিন্যাস আর কি। দেখবেন যিনি সেই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ উচ্চমার্গীয় মহাত্মা তিনি বাতানুকূল ঘরে সেবকবেষ্টিত হয়ে আছেন আপনার উদ্ধারের জন্য, জনতার সেবার জন্য আত্মনিয়োগ করেছেন। জনতা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে সাষ্টাঙ্গে কি, পঞ্চাঙ্গে, কি চতুর্থাঙ্গে ইত্যাদি ইত্যাদি প্রণাম জানাচ্ছেন। আপনি প্রশ্ন করবেন, দূর থেকে কেন? কারণ বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, মানুষ যখন প্রণাম করে কাউকে তখন তার দ্বারা কৃত পাপ যেই সে নীচু হয় অমনি সেই ঢাল বেয়ে প্রণাম গ্রহণ করা ব্যক্তিটির পায়ের ফ্যালেঞ্জেস, মেটাটারসাল, টারসাল, টিবিয়া-ফিবিউলা, ফিমার হয়ে তার আত্মাকে অধিগ্রহণ করে তাকে পাপিষ্ঠ করে তোলে। তার তখন নানা রোগ হয়, ও মৃত্যু হয়। এখন এইভাবে মহাত্মারা যদি জনতার পাপে পটাপট মরতে শুরু করেন তবে এই পাপের সাগরে নিমজ্জমান জনতার উদ্ধার কে করবে? তাই অমন দূর থেকে ভক্তকূলের ভক্তি প্রদর্শনের ব্যবস্থা। এবার আপনি যদি আবার জিজ্ঞাসা করেন, তা কোন বিজ্ঞানী এই তত্ত্ব প্রমাণ করেছেন? আমি বলব যারা গোমূত্রে কোরোনা বিদায়ের ব্যবস্থা করছেন তাদের জিজ্ঞাসা করেন গিয়ে, আমায় না।
এবারে আপনি যদি প্রশ্ন করেন যে, ঈশ্বর কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে থাকেন না, এই কথা আমি বুঝলাম কি করে?
সে উত্তরও আছে। প্রমাণ সহিত দেব। দেখুন আমাদের শাস্ত্রে আছে যে যখন যখনই ধর্মের গ্লানি হবে তখন তখনই তিনি আসবেন, আছে কিনা? আছে। তারপর যারাই হিন্দুধর্ম নিয়ে নাড়াঘাঁটা করেছেন তারাই জানেন আমাদের অবতারদের আসার একটা ক্রোনোলজি পাওয়া যায়? যায়। অতএব এইবার দেখুন, আলোচনায় আসা যাক।
এক্কেবারে প্রথম অবতার, রামচন্দ্র, রাজার ছেলে। কোথায় জন্মালেন? রাজার বাড়ি। বাকিটা আর বলার কিছু নেই, ওনার সম্পূর্ণ লীলা আমরা জানি, সে সবই জঙ্গলে, যুদ্ধক্ষেত্রে, দুষ্টনিবারণে। একবার হাতজোড় করে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রণাম করুন। আমি পরেরটায় আসছি।
এইবার এলেন কৃষ্ণ। হিন্দুধর্মে সবচাইতে জনপ্রিয় অবতার, এখনও ওনার জনপ্রিয়তার ধারেকাছে কেউ নেই, মায় এখনও হিন্দী সিনেমার গানে ওনার উল্লেখ, যেখানেই প্রেম সেখানেই কৃষ্ণ। তা তিনি কোথায় জন্মালেন? না কারাগারে। ওনার জীবনের বাকিটাও আর উল্লেখ করার কিছু নেই, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বৃন্দাবন --- সে এক অদ্ভুত লীলা। একবার সাশ্রুনয়নে সেই নীলপাদপদ্ম স্মরণ করুন মনে মনে, অঞ্জলি দিন, আমি আরো এগোচ্ছি।
এরপর যে দশাবতারের উপাখ্যান আছে তাতে ঈশ্বর অনেক মানুষী তনুর পাশাপাশি অনেক অমানুষী তনুতে লীলাখেলা করেছেন, সে কথায় আর গেলাম না। কিন্তু বুদ্ধকে নিলাম। সেই কথাতেই আসছি।
গৌতম বুদ্ধ রাজার ছেলে। তারপর সংসার ত্যাগ করে বাকি আশিটা বছর ভারতের নানা জায়গায় ঘুরলেন। ধর্মপ্রচার করলেন।
তারপর ধরুন শঙ্করাচার্য জন্মালেন। তিনি এক সাধারণ পরিবারে দক্ষিণ ভারতে জন্মালেন।
তারপর ধরুন আমাদের নিমাই, তিনিও এক সাধারণ পরিবারে জন্মালেন।
তারপর বেশ কিছু অবতার একসাথে এলেন বা মোটামুটি কাছাকাছি সময়ে এলেন। রামকৃষ্ণদেব, শিরডির সাঁইবাবা, ওমকারনাথ ঠাকুর, লোকনাথবাবা, অনুকূল ঠাকুর, রামঠাকুর, রমণ মহর্ষি, বালক ব্রহ্মচারী, আনন্দময়ী মা প্রমুখ।
আমি যদি কারোর নাম উল্লেখ করতে ভুলে গিয়ে থাকি আমায় ক্ষমা করবেন, কারোর প্রতি আমার বিদ্বেষ নেই। এদের মধ্যে এক একজনের লীলা এক একরকম। তবে দেখেছি এক একজনের ভক্ত অন্য অবতারকে হয় নিন্দা করেন, নয় ছোটো চোখে দেখেন। সে তর্কে আমি যাচ্ছি না। সে রুচি আমার নেই।
আমি সবাইকেই প্রণাম জানিয়ে একটা কথাই বলতে চাই, দেখুন এনারা কেউ কিন্তু তাদের জন্মানোর আগে প্রতিষ্ঠিত কোনো মঠে বা আশ্রমে যোগ দিতে যাননি। মঠে বা আশ্রমে যে জন্মানো যায় না সে না জানার মত নির্বোধ আমি নই। কিন্তু এরা যদি জানতেন মঠে-আশ্রমে ঈশ্বর স্বমহিমায় আছেন তবে কি এনারা সেখানে নিজেকে যুক্ত করতেন না? না, কেউ তার আগের প্রতিষ্ঠিত কোন আশ্রমে বা মঠে নিজেকে যুক্ত করেননি, প্রত্যেকেই পৃথক থেকেছেন, নিজের আশ্রম খুলেছেন, বা তার ভক্তেরা খুলে দিয়েছেন।
অগত্যা প্রমাণিত হল ঈশ্বর মঠে-আশ্রমে থাকেন না, তাদের লিগ্যাসি মঠে-আশ্রমে থাকে। লিগ্যাসির একটা বাংলা হল উত্তারাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত উইলসম্মত সম্পত্তি। এইক্ষেত্রে কথাটাকে অন্যভাবে নিতে হবে অর্থাৎ অধ্যাত্মিক একটা লিগ্যাসির দিকে তারা যান। এই অধ্যাত্মিক লিগ্যাসি কি ভগবান? কদাপি নয়। ভগবান গীতাতে বলেছেন না তিনি কি কি, কোথায় কোথায় অধিষ্ঠিত, পড়েননি নাকি? সেখানে কোথায় বলেছেন আমায় খুঁজতে মঠে-মিশনে ইত্যাদিতে যাও? বলেছেন নিজের আত্মায় খোঁজো। নিজের মধ্যে খোঁজো, সেখানেই আমি।
আপনি বলতে পারেন, তবে ওই যে বলা হয়েছে আমার ভক্তেরা যেখানে একসাথে গান করেন নাচেন সেখানে আমি?
আরে ভাই, সেখানে তো বলা নেই যে আপনাকে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে তা করতে হবে। কারণ প্রতিষ্ঠানে যা হয় তা রেগুলার কারিকুলাম, অনুষ্ঠান, প্রাত্যহিকী – আপনি ফস্ করে একটা নিয়মের বাইরে গান গেয়ে ওঠেন তো দেখি সেইখানে গিয়ে, হয় আপনাকে চুপ করাবে, নইলে অর্ধচন্দ্র দেবে ওই মহাত্মাগণ, নইলে আপনাকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে কোনো পদস্থ মহাত্মার।
তাই বলছিলাম, অবশেষে কথাটা এই ঈশ্বর যেমন বিশ্বচরারচরের অণুতে-পরমাণুতে অধিষ্ঠিত আছেন বলে শাস্ত্রে আছে, আজও তেমনই আছে কথাটা। আপনারাই খামোখা এদিক ওদিক লিগ্যাসিকে ঈশ্বর ভেবে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছেন। সেখানে তালা ঝুললে ভাবছেন ঈশ্বর ভয় পেয়েছেন। উঁহু, মোটেও না, যিনি আত্মস্বরূপ, যার দেহ নেই তার শরীরে কোরোনা কি করবে গা? কোরোনার লাইপোপ্রোটিন না কি সব আছে না? তার শুধু শরীরেই আগ্রহ, আত্মায় নয় রে বুদ্ধুরাম।
তাই বলি কি মনটাকে শান্ত করে, যেক'টা দিন বেঁচেবর্তে আছো বাপু, চাদ্দিকে এট্টু ভালোবেসে, না ঘেন্নাপিত্তি করে তাকাও তো দেখি বাপ আমার, কথা দিচ্ছি তিনি মনের মধ্যে শান্তি ঢেলে দেবেন। তারপর কোথায় কি হল মনই যাবে না। কেমন একটা ফুর্তি ফুর্তি ভাব আসবে। তবে হ্যাঁ, ওইসব মানুষগুলো যারা এর মধ্যেও নানা সত্যকারের প্রতিষ্ঠানে তোমার আমার সুরক্ষার জন্য প্রাণ হাতে করে লড়ে যাচ্ছে তাদের কাছে শ্রদ্ধাবনত হওয়াতে পুণ্যি বাড়বে এ আমি হলফ করে বলতে পারি। তাদের কাজের মহত্ব বুঝতে চোখকান বন্ধ করে বসতে হয় না বাপ আমার, চোখকান যত খোলা থাকবে তত বোঝা যাবে যে যতই ভববন্ধন খন্ডন করার প্রার্থনা করো না কেন, আদতে ওই ভববন্ধনেই তেনার লীলা।