মন বাইরের দিকে ছুটেছে। সারাক্ষণ তার বাইরে বাইরে খোঁজ। সে ছুটে মহাকাশকে ছুঁতে চাইছে, সে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে গিয়ে নুড়ি কুড়িয়ে আনতে চাইছে। সে আলোর বেগে ছুটতে চাইছে, মাতাল হাওয়ায় নাচতে চাইছে। সেই ছোটবেলায় একরকমের খেলনা ছিল, একটা যন্ত্রকে পাঁই পাঁই করে ঘুরিয়ে যাওয়া, ওর সাথে একটা দড়ি লাগানো থাকত সেটাও পাঁই পাঁই করে চরকীর মত ঘুরত। আমাদের মনটাও সেরকম। সারাদিন পড়িমড়ি করে ছুটছে। কেন ছুটছে? কোথায় যে যাচ্ছে সে নিজেও স্পষ্ট নয়। সকালে যেটা না হলেই চলছিল না, বিকালে সেটার থেকে ফালতু জিনিস কিচ্ছু নেই যেন। পশুদের এভাবে চললে অসুবিধা হয় না, কারণ তাদের পুরো সিস্টেমটাই আউটসোর্সিং-এ লেগে যায়। তাদের পুরো সত্ত্বাটাই বহিঃপ্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সমস্যা হল আমাদের তো তা নয়। আমাদের যে পুরোদস্তুর একটা অন্দরমহল আছে। তার দায়িত্ব কে নেবে?
আমার যত সুখ দুঃখ ব্যথা বেদনা আবেগ উচ্ছ্বাস ইত্যাদি সবই তো এই অন্দরমহলের ব্যাপার। সে পাড়ার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে যে আমারই সমূহ ক্ষতি। ক্ষতি না? বাইরের আঘাত তো বাইরে লাগে না, সে তো আমার অন্দরমহলের সব ক'টা কাঁচের দরজা জানলা নাড়িয়ে দিয়ে, সেরকম আঘাত হলে কয়েকটা কাঁচ ভেঙে গুঁড়িয়েও যায় যে! আর অনভ্যস্ত আমি বেচারা, জানিই না কোন কাঁচটা ভাঙল, কোথায় কাঁচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে। অনভ্যস্ত তো অন্দরমহলের রাস্তাঘাটে! ফলে সেই কাঁচে পা কেটে রক্তাক্ত হই। যে আঘাতকে দুদিনে ঝেড়ে পরিস্কার করে অন্দরমহলকে সামলে ফেলার কথা, সেটাতেই আমার কয়েক বছর লেগে গেল হয়তো। কখনো কখনো আবার তাঁদের দ্বারস্থ হতে হয় যাঁরা অন্দরমহলের খবর রাখতে পারেন। তিনি মনোবিদ হোন বা কোনো সাধু-মহাত্মাই হোন। শেষেরটি বড়ই দুর্লভ।
নিজের অন্দরমহলের ভার নিজেকেই নিতে হবে। যাতায়াত বাড়াতে হবে। গলিঘুঁজিগুলো আবিস্কার করতে হবে যতটা পারা যায়। তখন হঠাৎ করে কিছু ভাঙলে চমকে উঠব না। মনে হবে, হ্যাঁ ওটা খুব আলগাভাবেই রাখা ছিল, আমি দেখেছিলাম। এই দেখে আসার জন্যই ভিতরের পাড়াটা ঘুরে আসা দরকার খুব মাঝেমধ্যেই। তখন বাইরের অতিবড় আঘাতও আমি ধীরে ধীরে সামলে নিতে সক্ষম হব। কারণ ব্যাথাটা কোথায় বাজছে, পুরোটা না হলেও কিছুটা বুঝেছি। অনেকে বলেন মন নিয়ন্ত্রণের কথা। আমার মনে হয় আগে পুরো সুইচবোর্ডের কোন সুইচের কি কাজ সেটা আগে বুঝি, তারপর না হয় নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা যাবে। না তো খুব গরম লাগছে যখন তখন হয়তো পাথার সুইচ না চালিয়ে রুম হিটারের সুইচে হাত দিয়ে বসলাম। এরকম বহু তথাকথিত মন নিয়ন্ত্রণের বহর দেখেছি। সেখানে সমাধানের চাইতে চাপা দেওয়ায় আগ্রহ বেশি। ফলে ভবিষ্যতে সেটা মনের গভীরে এমন পচন ধরায় যে আর কহতব্য নয়। কেন রে বাবা, মুখোমুখি হয়ে বোঝাপড়াটা সেরে নিলেই হয়, না চাপা দিয়ে।
এ তো গেল অন্দরমহলের যাতায়াতের কথা। এখানেই কি শেষ? না মশায়। আরো আছে। বেশ একটা মজার ব্যাপার আছে। আপনার বাড়ি সাজাতে যেমন ইন্টেরিয়ার ডিজাইনার পাওয়া যায়, ঠিক তেমন আমাদের যে অন্দরমহল নিয়ে কথা হচ্ছে, তারও ইন্টেরিয়ার ডিজাইনার পাওয়া যায়। তাঁরা যুগে যুগে জন্মেছেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে ফিরেছেন। খুব আকূলভাবে বলেছেন, স্যার আপনার অন্দরমহলটা একটু গুছিয়ে দিই। আমি কানে তুলিনি, এক তো এ অন্দরমহল বাইরে থেকে চোখে দেখা যায় না, না তো লোকের বাহবা পাবার কোনো সুযোগ আছে। তায় এ মাল পয়সাকড়ি চায় না। কে জানে কি মতলবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে এঁদের ভাগাও! না পুরো ভাগাও না। দেওয়ালে এঁদের ছবি লাগিয়ে দাও। বোঝো! যিনি আসলেন মনের ভিতরটা সাজিয়ে দিতে, আমি তাঁকেই সাজিয়ে রাখলাম আমার ঠাকুরঘরে, শোয়ার ঘরে, বসার ঘরে।
"সে যে মনের মানুষ কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়ন দ্বারে
ডাক না রে তোর বুকের ভিতর, নয়ন ভাসুক নয়নধারে"