Skip to main content
rama

আজ রামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথি। অবশ্যই এ বছরে এ তিথির গুরুত্ব অন্যরকম। রামকৃষ্ণদেব মানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা। কথা ক্রমে স্লোগান হল। স্লোগান ক্রমে ব্র্যাণ্ড ভ্যালু হল। ক্রমে অবতারে পর্যায়ক্রমে শ্রেষ্ঠ ঘোষিত হলেন - অবতার বরিষ্ঠায়। তারপরে সব কিছু প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গেল। মানুষ সোজা সাপটা দীক্ষা পেল, সিরিয়াল পেল, সিনেমা পেল। একটা ব্র্যাণ্ড তৈরি হয়ে গেল। একটা নির্দিষ্ট ছাঁচ তৈরি হয়ে গেল, ব্যস, সব শেষ হয়ে গেল।

    কি শেষ হয়ে গেল? স্পিরিটটা শেষ হয়ে গেল। এল নিয়ম, এল কৃষ্টি, এল প্রথা। কথামৃতের বিক্রি যথেষ্ট ভালো। নানা প্রকাশনী থেকে বের হয়। ওনার জীবন নিয়ে লেখা দুটো বই, এক, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ আর দুই, পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ। প্রথমটির রচয়িতা স্বামী সারদানন্দজী। দ্বিতীয়টির রচয়িতা সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। দ্বিতীয় বইটি রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃক ত্যজ্য, ওনাদের স্টলে পাওয়া যায় না, কারণ ওটা সাহিত্য প্রামাণ্য নয়। এরকম নানা কোন্দলে, নানা মতে, নানা দর্শনে মূল কথাটা চাপা পড়ে গেল দেশ জুড়ে যে তিনি আসলে সব ধর্মকে এক জায়গায় দেখেছিলেন

    কোনটা প্রধান হল? তিনি লেটেস্ট মডেল অফ অবতার, এবং তাই শুধু না, তিনিই শ্রেষ্ঠ। এ গোলমালটা যে হবে তা বিবেকানন্দ আঁচ করতে পেরেছিলেন, তিনি চিঠিতে বারবার লিখেছিলেন, "তবে একঘেয়ে গোঁড়ামি দ্বারা তাঁর ভাবের ব্যঘাত হয়-এইজন্য চটি। তাঁর নাম বরং ডুবে যাক - তাঁর উপদেশ (শিক্ষা) ফলবতী হোক। তিনি কি নামের দাস?" বিবেকানন্দ আরও বলছেন যে, "সর্বদা মনে রেখ যে, পরমহংস দেব জগতের কল্যানের জন্য এসেছিলেন - নামের বা মানের জন্য নয়। তিনি যা শেখাতে এসেছিলেন তাই ছড়াও।".... "everything must be sacrificed, if necessary, for that one sentiment-universality"

    কিন্তু বিবেকানন্দের শঙ্কাই সত্যি হল। আজ দেশে রামকৃষ্ণের শিক্ষার কোনো জীবন্ত ছবি নেই। কয়েকজন ব্যতিক্রমী মানুষের বিশ্বাসে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবে সে শিক্ষা সজীব হয়ে ওঠেনি। ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ সেই অর্থে মানুষের চিত্তের পরিবর্তন ঘটিয়ে উঠতে পারেনি। আজ গোটা বাংলা সেই প্রমাণ দিচ্ছে। এ বাংলা কার? কিন্তু দীক্ষা হচ্ছে হাজার হাজার, পাঠচক্র হচ্ছে, ভাষণ হচ্ছে, বই লেখা হচ্ছে সব হচ্ছে, কিন্তু মানুষের চেতনার যে পরিবর্তনের কথা ঠাকুরের মুখ থেকে উচ্চারিত হল সেই চেতনা উধাও হয়ে গেল। আজ বহু লোভী, অসৎ, চতুর মানুষের বাড়ি বাড়ি রামকৃষ্ণদেবের ছবি, মার্বেলের সিংহাসন, অমুক মহারাজের দীক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার স্টেটাস সিম্বল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের আঙিনা ছাপিয়ে রামকৃষ্ণের শিক্ষার অস্তিত্ব আজ কোথায়? আমাদের শিক্ষাঙ্গনে তিনি আজ অবধি অস্পৃশ্য। ধর্মের মানুষ করে রেখে তাঁর যে এই একটা ইমেজ তৈরি করে রাখা, এতে ফল তো ভালো হল না। 

    সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও বর্তমান যুগের স্বনামধন্য দর্শনের অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তী প্রমুখেরও একজন রামকৃষ্ণ আছেন। যিনি কোনো মঠের না, অবতার না, তিনি একজন দার্শনিক, একজন চিন্তাশীল মানুষ। সেই রামকৃষ্ণকে আজ ভীষণ দরকার আমাদের। 

    দীক্ষা হোক, মন্দির হোক, পূজা প্রার্থনা সব চলুক। যার যেমন বিশ্বাস সে নিয়েই সে চলবে, কিন্তু এর বাইরে একটা বড় রামকৃষ্ণ আছে। বৃহৎ, অপ্রাতিষ্ঠানিক, উদার, একা রামকৃষ্ণ। সেখানে তিনি কোনো প্রস্তরমূর্তি নন, তিনি জীবন্ত, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - তীর্থক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ কেন রামকৃষ্ণকে বলছেন,

“বহু সাধকের
   বহু সাধনার ধারা,
ধেয়ানে তোমার
   মিলিত হয়েছে তারা;
তোমার জীবনে
   অসীমের লীলাপথে
নূতন তীর্থ
   রূপ নিল এ জগতে;
দেশ বিদেশের
   প্রণাম আনিল টানি
সেথায় আমার
   প্রণতি দিলাম আনি।।"

    রামকৃষ্ণকে অনুধাবন করতে প্রথম শর্তই হল একটা বড় চিত্ত। কোনো সংকীর্ণতা, একঘেয়েমি ওনার ভাবের সঙ্গে যায় না। ওনার দর্শনের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু আমি যতগুলো পাঠচক্রে ঘুরে দেখেছি, কী অসীম সঙ্কীর্ণ মানসিকতা নিয়ে ওনাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেখানে ওনার উদার শিক্ষার একটাই সমাধান - “ওসব আমাদের জন্য না”... “ওসব অনেক উঁচু কথা”। কি স্পর্ধা আমাদের, আমি ছোটো হয়েছি বলে তুমিও ছোটো হও। তুমি যদি ছোটো না হও তবে তোমায় আমি ছোটো করে আমার ছাঁচে বেঁধে নেব। কি ভয়ানক ঔদ্ধত্য আমাদের, রামকৃষ্ণের কাছেও নাকি আসব, আবার বড় কথা শোনার মত চিত্তকেও তৈরি করে আসব না। কি সাংঘাতিক স্পর্ধা! যেন এভারেস্টকে একটা ঢিবি বানিয়ে দাও আমি ওর উপরে উঠে একটা পতাকা পুতে আসব, আমার বলে ঘোষণা করে আসব। বড় জিনিসকে নিজের করে পাওয়া যায় না, সেখানে নিজেকে বড় হওয়ার শর্ত লাগে, সে শর্ত পূরণে আমি নারাজ, তাই দাও আমার জন্যে একটা রামকৃষ্ণ পার্ক বানিয়ে, আমি নেচেকুঁদে আমোদ করে বেড়াই। 

    এ নিতান্ত আমাদের হতভাগ্য। আমাদের সবার হতভাগ্য যে রামকৃষ্ণোত্তর যুগেও এ দেশে দাঙ্গার ভয় থাকে। এ দেশে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের বীজ নষ্ট হয় না। কারণ আমরা অবশেষে রামকৃষ্ণকে একজন হিন্দু, কিছুটা ব্যতিক্রমী হিন্দু সাধক-অবতার --- এর বেশি দেখতে শিখলাম না। এ ক্ষতি শুধু হিন্দু বলে না, সমস্ত ধর্মের মানুষেরই ক্ষতি। কবিতার যেমন ভাবটাই আসল, ভাষাটা তার বাহক, ধর্মের তেমন উপলব্ধির মাধুর্যটাই আসল, বাকি সব শুধু বাহ্যিক। সে মাধুর্য যে পথেই আসুক আমার লাভ, আমার শান্তি, আমার সার্থকতা। রামকৃষ্ণের দর্শন যে কোনো ধর্মের মানুষের জন্যেই আলোকস্তম্ভের সমান। কোথাও এতটুকু সঙ্কীর্ণতা নেই। এমনকি নিজেকেও সম্পূর্ণ শূন্য করে তবে ছেড়েছেন। নিজের মুখের কথা - গুরু, কর্তা, বাবা বললে আমার গায়ে কাঁটা বেঁধে। নিজেকে ‘আমি’ না বলে ‘এখানকার’ বলতেন। এ ঢং না, এ ন্যাকামি না, এ বাড়াবাড়ি না - এটাই আদতে রামকৃষ্ণ। অপ্রাতিষ্ঠনিক দলহীন, একাকী আলোকের মত রামকৃষ্ণ। কাছে গেলে আমারই শান্তি। কিসের থেকে শান্তি? চিত্তে চলা নানা বিরোধের থেকে শান্তি। 

    দুর্ভাগ্য ভারতের। শিরডির সাঁইবাবা আর বাংলার রামকৃষ্ণ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মানুষ ছিলেন না। দু’জনেই সমসাময়িক ছিলেন। দু’জনেই কোনো ইন্টেলেকচুয়ালাইজেশানের মাধ্যমে ধর্মের নামে নানা বিরোধের সমাধান করতে চাননি, করেছেন নিজেদের জীবন আর উপলব্ধি দিয়ে। কিন্তু অবশেষে দু’জনেই প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে পড়লেন। দু’জনের ক্ষেত্রেই তাদের শিক্ষা থেকে তাদের ছবি, জন্মস্থান, পূজাপদ্ধতি প্রধান হয়ে পড়ল। নানা আনুষাঙ্গিক গৌণ প্রসঙ্গের চাপে মূল কথাটা চাপা পড়ে গেল - সমস্ত সংসার জুড়ে এক সত্যই বিরাজমান - তাঁর ধর্ম নেই, সাধন নেই, প্রথা-রীতি-রেওয়াজ নেই, গুরু নেই, শিষ্য নেই, অবতার নেই, মন্ত্র নেই। তবে কি আছে? তোমার চিত্ত আছে, যাকে মহতের স্পর্শে আনলে সে মহৎ হয়ে উঠবে, আর সে মহৎ তোমার চিত্তের কেন্দ্রে আছে, তোমার মন থেকে বৈরিতা গেলেই যা পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। বাদ বাকি ধর্ম যা, সে কিছুটা ব্যবসা, আর কিছুটা রাজনীতির প্রচ্ছন্ন রূপ। নানা গোষ্ঠীবদ্ধ ক্ষমতার চাতুরী। যদি বলো তোমরা তবে কে? রামকৃষ্ণ বলবেন, তোমার একগাছি বড় লোমের সমানও নই, আর সাঁই বলবেন, তোমার বিষ্ঠায় ঘুরে বেড়ানো পোকার চাইতেও অধম। যদি বলো, তোমাদের ধ্যান করব না তবে? তাঁরা বলবেন, অবশ্যই করবে, তবে যতটা নীচে নেমে এলে চিত্তে আমার ধ্যানের আসন পাতা যায়, ততটা নেমে এসো আগে।