সূত্র কথাটার অর্থ সুতো। আমার লজ্জা নিবারণের জন্য যে বস্তুটি সর্বাগ্রে প্রয়োজন - পোশাক, সে এই সহস্র সুতায় নির্মিত। আমার জীবনে সুতার প্রথম প্রয়োজন - আমার পরিধেয় বস্ত্র।
শুরু হল শিক্ষারম্ভ। সূত্রের নতুন অর্থ পেলাম। গণিতের সূত্র, পদার্থবিদ্যার সূত্র, রসায়নের সূত্র। সেই সুতো। এ কিরকম সুতো? এ চিন্তাকে গেঁথে রাখবার সুতো? ঠিক তা না, আবার তাও। বিজ্ঞান অর্থে বিশেষ জ্ঞান। আপেলটা মাটিতে পড়ল। তাতে একটা সূত্র পাওয়া গেল। কি সূত্র? না মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। অর্থাৎ শুধু আপেলটা না, আম জাম কলা লিচু, আমি তুমি কাকি মেশো, ইঁট পাথর ঢিল পাটকেল - যাই পড়ুক না কেন তা এক কারণেই পড়বে। মাধ্যাকর্ষণ। তা হলে এই নানা ঘটনার মধ্যে এক নিয়মকে খুঁজে পাওয়াই হল সূত্র। বিজ্ঞানী বলেন, এই সব ঘটনাকে আমি এই একটা সুতোয় বেঁধে ফেলেছি, আর প্রকৃতি আমায় বোকা বানাতে পারবে না। এই হল বিজ্ঞানীর সূত্র।
শুরু করেছিলাম পোশাক দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতঃ তার আগেই অজান্তেই আরেকটা সুতোর বাঁধনে আমি এসে পড়েছি। আমার বংশগত সুতো। এই সুতোর কথা প্রথম বলার চেষ্টা করেন এক ধর্ম যাজক, স্কুলে সবাই তাঁর নাম শুনেছি - মেন্ডেল সাহেব। তা তাঁর কথা কেউ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি। ভাবল ব্যাটার মাথা বিগড়িয়েছে। সারাদিন চার্চের সামনে মটর গাছ লাগায় আর তাতে যে কি রহস্য পায় কে জানে! অগত্যা সে বুড়োকে নিতান্ত অবসাদগ্রস্ত হয়েই ভবলীলাসাঙ্গ করতে হয়। তার বহু বছর পর আমরা টের পাই - আরে হ্যাঁ, একখান সুতোর মত জিনিস আছে বটে তো! যা কিনা এক প্রাণ থেকে আর এক প্রাণে যায়। আর শুধু যায়! ঠিকুজিকোষ্ঠী নিয়ে যায়, যেমন আমরা মেমোরি কার্ডে ডেটা ট্রান্সফার করি, সেরকম আর কি! বোঝো। তা সেই সুতোর নাম কি গা? তার নাম হল - ক্রোমোজোম। তাতেই তোমার আমার ইহকাল পরকাল, ভূত ভবিষ্যতের সুপ্ত তথ্য। ভাবা যায় এক সূতো সেই যুগ যুগ ধরে কালে কালে তার রঙ পাল্টাচ্ছে আর বিশ্ব চরাচরের রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছে।
আচ্ছা, এই সূত্রলীলা কি এখানেই শেষ? না গো। আরেকটা কথা না বললে যে সবটা বলা হয় না। সে হল দর্শনের সূত্র। চর্মচক্ষুর দর্শন না। অন্তঃশ্চক্ষুর দর্শন। ভগবান গীতায় বললেন, বন্ধু হে, সারাটা জগৎ এক সূত্রে গাঁথা, যেমন মালার পুঁথিরা সব এক সূত্রে গাঁথা, ঠিক তেমন।
এ হল প্রেমের সূত্র। সেই প্রেম সূত্রই হল সত্য। এক সত্য। সে সূতোতে পুঁথির মত এ জগতে সব গাঁথা। পালাবে কোথায়? তাই প্রেমে পড়ে তুমিও বাঁচো, আমিও বাঁচি। এ সুতো কাটতে পুরাকালে অসুরেরা চেষ্টা করেছিল, আজও করে আসছে। এ যে কালিদাসের বুদ্ধি ভায়া। এ বিশ্ব সংসারে যে সুতোর জোরে তার অস্তিত্ব, তাকে কেটে বাঁচা যায়? কেউ পারেনি কোনোদিন, ভবিষ্যতেও পারবে না। সেই সুতোকেই খোঁজো, আঁকড়ে ধরো। সেই আশ্রয়, আশা, আনন্দ, পরমানন্দ।