অন্ধকার। মহানিশা। কালীপূজোর রাত। শাস্ত্রর কথা থাক। পুরাণে, তন্ত্রে, বেদে কি লেখে সে কথা থাক। আজ মনকে অন্ধকারের সামনে দাঁড় করানোর কথা।
আমি অন্ধকারকে জানি না। তাই সে অন্ধকার? হয় তো বা। অন্ধকারকে না চিনলেও তাকে এড়িয়ে চলার যো নেই। সে অন্ধকার আমার খাটের নীচের হোক কি মহাকালের। সে আছেই। তার সাথে আমার সম্পর্ক ভয় আর কৌতুহলের। কতটা ভয় আর কতটা কৌতুহল জানি না। তবে একটা আরেকটাকে ছেড়ে থাকতে পারে না, এ বেশ বুঝি। কৌতুহলের সাথে ভয়ের মাত্রা যদি কিঞ্চিৎ অধিক করা যায় তবে তাকে আডভেঞ্চার গোত্রে ফেলা যেতে পারে। সে আলোচনা থাক।
কথা হচ্ছিল অন্ধকারকে নিয়ে। অন্ধকারের আকর্ষণ আছে? আছে। তবে সে ঘরসংসার পাতা সুখী গৃহস্থের না। সে আকর্ষণ অভিসারের আকর্ষণ। যেন অন্ধকারের পারে আছে আমার চিরকাঙ্খিত আলোর শিখা। আমাকে সেখানে যেতেই হবে। তবে আমার হাতের কাছে যে আলো? না তাকে চাই না। ঘরের কোণের প্রদীপকে নিভিয়ে ওই অন্ধকারের বুক চিরে আমার পথ। এ আলো ফাঁকি। এ আলো কুহকের মত। এতে না চেনা যায় নিজেকে, না পরকে। আমি সেই আলো চাই, যে আলোর কেন্দ্র আছে, পরিধি নেই।
সেই আলোকে পাওয়ার পথ কোথায়? ত্রিকালদর্শী আঙুল তুলে ইশারা করলেন অন্ধকারের দিকে। বুক ভর্তি অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। জন্মজন্মান্তরের অন্ধকার। বললাম, পেরোবো কি করে? ত্রিকালদর্শীর চোখ চকচক করে উঠল। দু'হাত তুলে বলে গেলেন, মাভৈঃ!
সে অন্ধকার জমল আরো গাঢ় হয়ে। ইশারায় ডাকল, আয়। বললাম, কে তুমি? সে অন্ধকার বললে, মা। আমি বললাম, মা কেন? সে অন্ধকার বললে, সৃষ্টির আদি রহস্যে ঘন অন্ধকার। কালের অন্ধকারে ঢাকা। আমি সেই অন্ধকার তাই। বললাম, যদি হারিয়ে যাই। সে অন্ধকার বলল, আরো অন্ধকারে যাবি। বললাম, তারপর? উত্তর আসল, অন্ধকার যত গাঢ় হবে, আলোর তৃষ্ণা তত গভীর হবে আরো। ক্রমে দেখবি, অরুণোদয়। বললাম, আলো ফুটবে? সেই আলোকে পাব? অন্ধকার বলল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি যাবে মিলিয়ে? অন্ধকার বললে, এ মহাকালের উষ্ণীশে ঢাকা যে আলো, সে আলো লালিত আমারই বক্ষে।
বললাম, সে আলোকে এখানে আনোনি কেন, সর্বজনসমক্ষে? উত্তর এলো, তবে সৃষ্টির মূল সুর হয় ব্যর্থ। সে আলোকে গ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জনের পন্থা এই আঁধারের পথ। এসো স্বীকার করো একে।
যদি না করি? তবে কালের গহনে যাবে পিষে। চুরমার হয়ে যাবে সব অস্তিত্ব। যেমন কালের গহনে গেছে বহু সভ্যতা, আলোকে করে অস্বীকার, মিথ্যা আলোর দর্পে। এ দেখো আমার কণ্ঠে, সে ছিন্নভিন্ন মস্তকের মালা।
আর এই যে স্তবস্তুতির আয়োজন? মিথ্যা খেলা। অন্ধকারকে সন্তুষ্ট করতে ভীরুর মিথ্যা আয়োজন।
ভক্তি মিথ্যা তবে? যে ভক্তি ভয়ের পায়ে অঞ্জলি দেয়, সে মিথ্যা। যে ভক্তি আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে বলে শীতল, সেই ভক্তি। সেই পায় অন্ধকারে আলোর পথ।
প্রণাম মিথ্যা তবে? মিথ্যা, যদি মিথ্যার পায় হয় প্রণত। কারণ, নতমস্তকে জাগে, সেই চরণের গুণ, যার পায়ে প্রণত সে।
কারণবারি? বলি? সংসারের মদিরা পানেও যদি পা না টলে, এসো।
বলির রক্ত যদি চিত্তের জড়ত্বের হয়, দাও।
মহানিশায় মহাকালের পথ দেখলাম। চিরকালের সুরে বাঁধা। বাণী একটাই, মাভৈঃ। ভয়কে করো জয়। অন্ধকারকে করো স্বীকার নির্ভয়ে। রাখো পা, মহাকালের আঙিনায়। চেনো নিজেকে, অনন্তে।