Skip to main content

        জানার একটা সীমা আছে। জানার একটা দৃষ্টিকোণ আছে। যাকে যা জানছি তাকে অনুভবে জানছি না তথ্যে জানছি সেও আছে। জানার পরিসরের বাইরে আরো অনেক এমন কিছু আছে যা আমার জানা উচিৎ ছিল, আবার জানার মধ্যেও এমন অনেক জিনিস আছে যা আমার না জানলেও চলত। এই জানা আর অজানার মধ্যে যে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা তা নিয়ে বেশ একটা মজা আছে। অহংকারটা আছে এর মধ্যে কোথাও একটা। বনের মধ্যে যেমন বাঘ লুকিয়ে থাকে তেমন। ব্যাটা ঘাপটি মেরে বসে থাকে শিকারের জন্য। যখন শিকার নেই, তখন সে-ও নেই।
        আমাদের অতীতে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ ছিলেন, বর্তমানেও আছেন। মজা হল, অতীতে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সময় আর প্রাপ্ত তথ্যের সীমারেখায় বন্দী। তাদের কারোর উপর আমার প্রেম বা দ্বেষ থাকলে আমরা সেই তথ্যের উপর আমার কল্পনার রং চড়িয়ে যা বানাই তা গল্প। সে গল্প পুরো মিথ্যাও নয়, পুরো বাস্তবও নয়। বাস্তব আর মিথ্যার মধ্যে একটা সুক্ষ্ম স্থান আছে – সেই সত্য। কারণ মিথ্যাকে মিথ্যা জানতেও একটা সত্যবোধ লাগে। নইলে ভিত্তিহীন কল্পনাকে আমরা বলি মায়া – ইলিউশান। সেই অন্তর্বর্তী সত্যের এক রত্তি এদিক ওদিক হলেই তার শুদ্ধতা নষ্ট। সেই সত্যই ভাবগত সত্য – ঋত। 
        এখন কল্পনার সমস্যা হল সে অব্জেক্টিভ নয় অর্থাৎ সে বস্তুগত নয়, সে বিষয়গত – সাব্জেক্টিভ। আমার ব্যক্তিত্বের ধাঁচ (স্কিমা) অনুসৃত কল্পনা এমন একটা বিশেষ প্রকার যা আমার ব্যক্তিত্বের সীমাবদ্ধতা দুষ্ট, সন্দেহ নেই। তাই আমার জানা আর কল্পনার দ্বারা সৃষ্ট কোনো অতীত মানুষের তথা ঘটনার রূপচিত্রে আমার নিজস্বতার অংশ অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে একি শুধু অতীতের ক্ষেত্রে, তা তো নয়। তবে জেনোফন যে দৃষ্টিতে সক্রেটিসের ছবি এঁকেছিলেন, প্লেটো তার থেকে এত উন্নত ছবি আঁকলেন কি করে? কারণ ওই যে, ফাঁকা অংশটায় যে কল্পনার রাজত্ব, সে তো স্রষ্টার নিজের মনের মাধুরী। কিন্তু সব সময় যে সে মাধুরীই থাকবে তার কি নিশ্চয়তা আছে, গরলও তো থাকতে পারে! 
        তবে এই দাঁড়ালো যে, যা জানি তা খানিক তথ্যনির্ভর আর বাকিটা আমার কল্পনানির্ভর। আমার জানতে যে তথ্যাবলী লাগে, সেই তথ্যাবলীর ফাঁকটুকু পূরণ করে আমার কল্পনা। যে কল্পনা আমার ব্যক্তিত্বের রঙে রাঙা। তাই অতীতের ধারণা আমাদের যত সুস্পষ্ট বর্তমানের নয়। বর্তমানকে জানা কঠিন শুধু নয়, অনেকাংশেই অসম্ভব। বর্তমান - যা থেকে অতীতের জন্ম হচ্ছে এবং যে নিজে ভবিষ্যতের বুকে হামা দিচ্ছে। বর্তমান কোনোদিন দাঁড়ায় না, হামা দেয়। কারণ এক, বর্তমান সর্বদাই সদ্যজাত। তার মধ্যে খানিকটা পক্কতার রঙ যেই ধরে সে অতীতের হতে শুরু করে। যদিও এই সন্ধিক্ষণটা ধরা খুব শক্ত। তখন প্রায়শই কোনটা বর্তমান আর কোনটা অতীত গুলিয়ে যেতে থাকে। আমাদের অহং শিকারি বেশিরভাগ সময়েই সেই সদ্য অতীতকে বর্তমান বলে প্রমাণ করে, নিজের মূঢ় নিশ্চয়তার নখ দাঁত নিয়ে সদ্যজাত কোমল বর্তমানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বর্তমানকে নিজের বিষাক্ত বা সুমিষ্ট কল্পনা দিয়ে বিকৃত করার সুক্ষ্ম কৌশল রপ্ত করে। অন্যকে বিভ্রান্ত করে, ক্রমে নিজেও বিভ্রান্ত হয়, এইভাবেই অহং ধ্বংসের দিকে যায়।
        বর্তমান সদা সদ্যজাত, নিষ্পাপ, প্রাণপ্রাচুর্য আর সম্ভাবনায় ভরপুর। তবে আমরা বর্তমানকে জানি কি করে? প্রথম কথা স্বীকার করতেই হয়, আমরা কেউ কোনোদিন সম্পূর্ণ অর্থে বর্তমানকে জানতে পারি না, পারবও না স্পষ্ট করে। যেমন চোখের খুব কাছে কোনো বস্তু এনে ধরলে আমরা তার স্পষ্ট রূপ দেখতে পাই না।তাকে খানিক চোখের থেকে দূরে না সরালে সে স্পষ্ট নয়। তবে উপায়? উপায় দুটো, এক, অতীতভূত বর্তমান আর স্বজ্ঞা নির্ভর বোধ। অতীত নির্ভরতার কথা খানিক আগেই বললাম। যার থেকে জন্মায় যত মৌলবাদ, সঙ্কীর্ণ মতবাদ, ক্ষণিক আত্মতুষ্টির বোধ। 
        স্বজ্ঞার ক্ষেত্রে এর বিপরীত। আমি যা কিছু জানি তা অনির্দিষ্ট কোনো এক চিরন্তন চেতনার মধ্যে দিয়েই জানি। সেই চিরন্তন চেতনার কোনো রূপ বা সংজ্ঞা হয় না। তাকে আমাদের শ্রদ্ধেয় কান্ট মহাশয় পিওর রিজিন বলে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন বলা হয়েছে, নিউটন আপেল পড়তে দেখলেন বটে কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটা তো আর পড়তে দেখেননি আপেলের সাথে ট্যাগ করা অবস্থায়? সে তো তিনি মননের মাধ্যমেই জেনেছেন, এও তেমন। তবু এত কিছুর পরও মনে রাখতে হবে যে সে কিন্তু অধরাই থেকে যাবে, আর সেখানেই আমাদের নিজেদের হাত থেকে মুক্তি। আমা হতে জাত অতিঠিক আর অতিভুল --- দুইয়ের হাত থেকেই আমার মুক্তি। 
        কবিতার আনন্দ সেখানেই। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ের হয়েই থাকে। কবিতাই একমাত্র যা চিরকালীন। তাই পৃথিবীতে গভীরতম কথাগুলোর বাহক তথা প্রকাশক কবিতাই। বাস্তব আর মিথ্যার মধ্যে সত্যের সেই সুক্ষ্ম অবস্থানটায় একমাত্র কবিতাই খুব নিশ্চিন্তে দাঁড়াতে পারে। সে বোঝায় না, উপলব্ধি করায়। সে ব্যাখ্যা করে না, দর্শন করায়। তাই প্রয়োজনের মুক্তি যদি ভাষায় হয়, তবে ভাবের মুক্তি অবশ্যই কবিতায়।