(আজ শিক্ষক দিবস। কিছু জিনিস শেখানো যায়, কিছু যায় না। জীবন যত্ন নিয়ে শিখিয়ে দেয় অনেক কিছু, যা মানুষের ভাষা শেখাতে পারে না। এ লেখাটা লিখে ফেললাম আমার খুব কাছের কিছু বন্ধুদের তাড়নায়। ভালোবাসা তো আতসকাঁচের মত, অতি ক্ষুদ্রকে অতি বৃহৎ করে দেখার ক্ষমতা তার আছে।
অতএব লিখেই ফেললাম। লিখবার ধারাটি সম্পূর্ণ আমার মত করে বানিয়ে নিয়েছি, যে ভাবে বলতে আমার সুবিধা হবে সেইভাবে।)
=================
জ্ঞান – ১। বস্তুগত বা প্রকাশিত (Explicit Knowledge); ২। আত্মগত বা অপ্রকাশিত (Tacit Knowledge)
আমি যা জানি তা কি চাইলেই জানাতে পারি? যেমন কাউকে 'সাইকেল' চিনিয়ে দিতে পারি। কিন্তু কি করে সাইকেল চালাতে হবে সেই জ্ঞানটাকে কিভাবে একজনকে দিতে পারি? সেটা তাকে নিজে নিজে শিখে নিতে হবে।
মানুষের প্রকৃতিতে তিনটে বড় দিক আছে বলা যায়--- ১। বুদ্ধি, ২। নীতি, ৩। অনুভূতি
=========
বুদ্ধিগত জ্ঞানকে আমি বলতে পারি বিনিময়যোগ্য। আজকাল একটা কথা শুনি, KT --- Knowledge Transfer, অর্থাৎ, যে জ্ঞান বিনিময়যোগ্য। যেমন শুনি কেউ একটা নির্দিষ্ট পদে কাজ করতেন, তিনি যখন সেই পদ ছেড়ে অন্যত্র যাচ্ছেন, তখন সেই পদে নতুন আসা মানুষটাকে তার জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে একটা কথা একটু বলে নেওয়া যেতে পারে, এই যে জ্ঞানটা তিনি অন্য মানুষের সাথে বিনিময় করে নিচ্ছেন, সেকি শুধু তথ্য, না অভিজ্ঞতাও? যেমন কেউ যখন সাইকেল চালানো শিখছে, তখন যেমন তাকে দুই চাকায় ভারসাম্য রাখার কৌশলটা নিজেকেই শিখে নিতে হচ্ছে, কিন্তু আমি যখন তাকে বলছি মোড় এলেই আগে বেল দিবি, তখন আমি কি আমার অভিজ্ঞতা তার সাথে শেয়ার করছি, না তাকে কোনো তথ্য দিচ্ছি? বলা যেতে পারে আমার অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য দিচ্ছি। তবে এও একটা তথ্যই, যা আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে পেয়েছি। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা আহরণের কৌশলটা শেখাতে পারছি না, সে তাকে নিজেকেই শিখে নিতে হবে।
এই বুদ্ধিগত জ্ঞানের ক্ষেত্র অনেক আছে, অবশ্যই বিজ্ঞান তার মধ্যে একটা বড় রাজ্য। তারপর সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতিবিজ্ঞান, ব্যবসা ইত্যাদি সমস্তই এই বিশাল অংশের অন্তর্গত।
পর্ব – নীতি
==========
'নীতি' শব্দটা ঠিক যাচ্ছে না। কথাটা হবে নৈতিকতাবোধ। বিবেকবোধ। একজন মানুষের উচিত-অনুচিত বোধ। যার শাখায় ধর্ম, দর্শন বেড়ে উঠেছে। পুষ্ট ও অপুষ্ট দুই-ই করে এসেছে।
এই বোধটাকে কি আমরা কাউকে শেখাতে পারি? এই প্রশ্নের মীমাংসা নিশ্চয় একবাক্যে হবে না। আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা – এর কোনোটাই খুব সদর্থক কিছু বলে না। প্রথম কথা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে কিছুতেই একটা মানুষকে নৈতিকভাবে উন্নত করতে পারে না, তার প্রথম প্রমাণ প্রতিটা পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রহরার নিখুঁত ব্যবস্থার প্রয়াস। যারা পরীক্ষা দিতে আসছেন, তারা যেন অসদ উপায়ে পরীক্ষা না দেন তার প্রয়াস। অর্থাৎ, শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিবেকের উন্নতির গ্রাফটা সমান অনুপাতে বাড়ে না।
তবে আমাদের সভ্যতার উন্নতি বলতে আমরা কি বুঝব? গুহা থেকে আজকের বহুতল নানা সুখ-সুবিধাযুক্ত আবাসন, চিকিৎসা ইত্যাদি নানা শাখায় উন্নতিকে আমরা কি বলব? অবশ্যই সভ্যতার উন্নতি। কিন্তু কোথাও একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে গভীর আলোকপাত অবশ্যই করে গেছেন সত্যজিৎবাবু তার ‘আগন্তুক’ সিনেমায়। সভ্যতাকে প্রশ্ন করছেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। সভ্যতাকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছেন। আপাত মনোহর তত্ত্বগুলোকে নেড়ে ঘেঁটে তাদের অসারতায় দাঁড় করাচ্ছেন। শুধু ‘আগন্তুক’ নয় অবশ্যই, শাখা-প্রশাখা, গণশত্রু – শেষ এই তিনটি সিনেমাতেই মানুষের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্ন করেছেন সত্যজিৎ রায়।
মানুষের সততার বোধ ও সহানুভূতির বোধ অতি প্রাচীন। এর কোনোটাই সে বাইরে থেকে শেখে না। এ বোধ সে নিয়ে জন্মায়। সততার বোধ আর অনুকম্পার বোধকে একত্রে আমরা নৈতিকতার মূল বলে থাকি। সেই সততার বোধ আর অনুকম্পার বোধকে কিভাবে কোন ক্ষেত্রে আমরা প্রয়োগ করতে পারি সেই নিয়ে তৈরি হয়েছে আধুনিক যুগে নীতিবিজ্ঞান বা এথিক্স। কিন্তু এর মূলে ওই দুটো শব্দই – সততার বোধ আর নৈতিকতার বোধ। সেই বোধের প্রতি কোনো ব্যক্তির আগ্রহ বা সহজ প্রবণতা থাকবে কি থাকবে না সে জটিল মনস্তত্বের ব্যপার, কিন্তু বোধটা থাকবেই।
এতএব এই দুই বোধকে আমরা পৃথিবীর যে কোনো সভ্যতার প্রাচীন সাহিত্যে খুঁজে পাব, এবং আজকের দিনে দাঁড়িয়েও আমাদের এই উত্তর আধুনিক সভ্যতায় তার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাব। সে সক্রেটিসের কথাই হোক, কি উপনিষদের গল্প।
পর্ব – অনুভূতি
===========
আমাদের অনুভূতির রাজ্য। ঠিক তা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি আসলে আমাদের আবেগের রাজ্যের কথা, বা আমাদের প্যাশনের কথা। প্যাশনের বাংলা কি বলি বলুন তো? অস্থির করে তোলা আবেগ? ঠিক হচ্ছে না। উত্তুঙ্গ আবেগ? কেমন একটা ভায়োলেন্ট শোনাচ্ছে না? ঠিক আছে, বরং 'প্যাশন'ই বলি, যার শাখায় সাহিত্য, শিল্প, সিনেমা ইত্যাদি সৃষ্টি হয়ে আসছে কালে কালে।
এই প্যাশন কি আমরা কাউকে শেখাতে পারি? ক'দিন আগে আমাজনে একটা ওয়েব সিরিজ দেখলাম। আমার ভীষণ ভালো লাগল, বন্দিশ-ব্যাণ্ডিট। সেখানে নাসিরুদ্দিন তার নাতিকে গান শেখাতে গিয়ে বলছেন, তোমার গানে টেকনিক্যাল দিক ঠিক আছে, কিন্তু প্যাশন কম, বড্ড কেঠো। আমার মনে পড়ল 'বৈজু-বাওরা' সিনেমার কথাটা, “দর্দ লাও”। প্যাশন নিয়ে এসো।
কিন্তু কিভাবে? কেউ তো কারোর প্যাশন কাউকে দিয়ে যেতে পারে না। পারে কি? না। আবার দেখুন এই প্যাশনও আমাদের সভ্যতার ইতিহাসের আগের থেকেই একই রয়ে গেছে। আমাদের হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ ইত্যাদি যা কিছু আছে, তা সে প্রাচীন কাল থেকেই আছে। হ্যাঁ, আমরা কালের সাথে সাথে কিছুটা সংযত হতে শিখেছি বটে, তাও তেমন একটা খুব গভীরে গিয়ে কি? তা নিশ্চয় নয়। আমাদের একটা প্যাশন আছে – ভয়। সেই ভয়ের দাপটে আমরা বেশ খানিকটা সংযত হতে বাধ্য হয়েছি বটে। পুলিশ, আইন-আদালত ইত্যাদি নানা উপকরণ আমাদের সমাজের চারদিকে প্রহরার মত জেগে আছে আমাদের সংযমকে টিকিয়ে রাখবে বলে।
কিন্তু আমাদের হৃদয়বৃত্তির মূল ও মৌলিক উপাদানগুলো কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে বলুন? আমি যখন প্রাচীন তামিল কবিতা 'কুরোন্তোকাই' পড়ছিলাম, নরনারীর প্রেমবিহ্বল সেই পদে কি আমি রস পাইনি? পেয়েছি তো। কিম্বা আরেক প্রাচীন তামিল সাহিত্য থিরুকুরালে প্রেমের যে বর্ণনা রয়েছে, সেকি আজকের নর-নারীর হৃদয়বৃত্তির চাইতে আলাদা? মোটেও নয়।
কিন্তু এ ক্ষেত্রেও একই কথা – যে বোঝে, সে বোঝে।
উপসংহার
========
সিদ্ধান্ত
------------
দেখা যাচ্ছে, আমাদের বৌদ্ধিক সত্তা ছাড়া, বাকি যে দুই সত্তা – নীতি ও আবেগ – এই দুইকে আমরা প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি একই স্তরে দেখছি। অবশ্যই যেভাবে আমি সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছি সেই দৃষ্টিভঙ্গীতে।
কিন্তু বৌদ্ধিক রাজ্যে আমরা ক্রমে অগ্রসর হয়েছি। আজকের বিজ্ঞানের সাথে অবশ্যই দুশো বছরের আগের বিজ্ঞানের প্রচুর পার্থক্য। কিন্তু আজকের কবিতা আর প্রাচীন কবিতায় ভাষার আর প্রকাশের পার্থক্য থাকলেও অনুভবের কোনো পার্থক্য অবশ্যই নেই। আর রইল নৈতিক বোধ, সেখানেও সত্যের প্রতি ও অনুকম্পার প্রতি আগ্রহকেই ধর্মের মূল কথা বলা হয়েছে। কোনো ধর্মই মানুষকে মিথ্যাবাদী ও নিষ্ঠুর হতে শেখায় না। তবে মানুষের সভ্যতার মূল কথা হল বিজ্ঞানের আর কিছুটা সংযমের প্রতিষ্ঠা। বাকি মূলগতভাবে সবটাই এক। আমরা আমাদের বাইরেটাকে আরো সুখ-সুবিধায় ঢেলে দিয়েছি বিজ্ঞানে, আর আমাদের প্যাশনকে বা এক্ষেত্রে অন্ধ-আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছি নানা সামাজিক বিধিতে।
বুদ্ধির উপজীব্য – সত্যের বা ফ্যাক্টের অন্বেষণ। নীতির উপজীব্য – নৈতিক সাধু জীবনের অন্বেষণ। আবেগের উপজীব্য – আনন্দ ও চিত্তসুখের অন্বেষণ।
পর্যবেক্ষণ ও প্রশ্ন
---------------------
আমাদের আজকের সমাজে প্যাশন ও বুদ্ধিগত চর্চা তুঙ্গে। কিন্তু নৈতিক জীবনের উপর আগ্রহ কম। ধর্ম তার অন্ধতায় প্যাশনের সাথে হাত মিলিয়েছে। সত্য ও অনুকম্পার চাইতে তার বিচরণ রাজনৈতিক রাজ্যেই বেশি। বাংলায় একটা কথা আছে – ভ্রষ্ট হওয়া। বুদ্ধি ও প্যাশন দু'জনেই যখন নীতিবুদ্ধি বা বিবেকবুদ্ধির হাত ছেড়ে যায় তখন সে নিজেই নিজের ক্ষতিসাধন করে বসে। দু'জনেই মাত্রা ঠিক রাখতে পারে না। অবশ্যই তা রাখার কথাও তাদের নয়।
তবে প্রশ্নটা কি? আমি আগে বলেছি কাউকে নৈতিক জীবনে বাইরে থেকে চেষ্টা করে ফেরানো যায় না, এবং এও বলেছি, কাউকে প্যাশনও শেখানো যায় না। এই দুটোই হল অ-বিনিময়যোগ্য জ্ঞান বা বোধ।
কিন্তু যায় তো, এমন উদাহরণও তো আছে। বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, রামকৃষ্ণ, চৈতন্য প্রমুখ মানুষদের সংস্পর্শে এসে মানুষের চরিত্রের আমূল পরিবর্তনের কথা তো আমরা জানি। ইতিহাস তার সাক্ষী। আজও এরকম ঘটনার সাক্ষী যে হই না, তা তো নয়। অনেককেই শুনেছি, অমুকের প্রভাবে তার জীবনের গতিপথ ভালোর দিকে ফিরে গেছে। তবে সে কিসের শক্তিতে? এর উত্তর হয় তো 'চরিত্রশক্তি'।
মানুষ সুখী হয় কিসে? জ্ঞানে, প্রেমে, না বোধে? এর উত্তর হয় তো, বোধে। একজন বোধসম্পন্ন চরিত্রশক্তি হয় তো অপর একজনের বোধকে প্রভাবিত করতে পারে। বুদ্ধিগত তত্ত্বশিক্ষায় যে কিছু হয় না সে আমাদের চারদিকের বর্তমান পরিস্থিতিই সাক্ষী। কিন্তু একজন সঠিক চরিত্রের মানুষ অনেকগুলো চরিত্র গঠন করে দিতে পারে এর উদাহরণও আছে। তবে সেও নিশ্চয় এক শক্তি।
আবার এমন মানুষ আছে যারা অন্যের আবেগকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন যে কোনো পথের নেতা গোছের মানুষ। একজন মানুষ অনেক মানুষকে যখন প্রভাবিত করে, সে জনতার আবেগের উপর তা করে থাকে। সে মানুষ ভালো-মন্দ দুই হতে পারে। ইতিহাসে এমন দুই ধারার নেতার উদাহরণ প্রচুর।
কিন্তু বোধকে প্রভাবিত করে এমন মানুষের সংখ্যা সবসময় মুষ্টিমেয়। কিন্তু সেই পারে একটা যুগের গতি ফিরিয়ে দিতে। আমরা যাকে বলি সংস্কারক।
প্রশ্ন হল, সে সংস্কারক তৈরি হয় কিসে? এর উত্তর এক মহাকাল ছাড়া কেউ দিতে পারে কি?