Skip to main content
শান্ত থাকা মানে কি নিষ্ক্রিয় থাকা? স্থির থাকা মানে কি উদাসীনতা? জড়তা কি শান্তি দিতে পারে? বিহ্বল হয়ে পড়া, অস্থির হয়ে পড়াই কি বিপ্লব? ধৈর্যচ্যুতি ঘটাই কি আন্দোলন? সহ্যের সীমারেখা ছাড়ালে যে চীৎকার, সেইটাই কি প্রতিবাদ? মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা, মানুষকে তাতিয়ে দেওয়া, মানুষকে উস্কে দেওয়া - এর মানে কি নেতৃত্ব দেওয়া? জড়ত্ব আর উত্তেজনার মাঝখানে একটা অবস্থান আছে - জাগ্রত অবস্থা। যে জাগ্রত সে সচেতন। সে উত্তেজিতও নয়, জড়ও নয়। বাংলার গ্রামে যে এককালে বাউল, কীর্তন, পল্লীগীতি ইত্যাদির চল ছিল, তা কি মানুষকে জড়ত্ব দিত, না শান্তি? সারাদিনের নানা কর্তব্য, সফলতা-ব্যর্থতা, সুখ-দুঃখের মধ্যে নিজেকে অক্ষুব্ধ রেখে চলার একটা ব্যবস্থাপত্র তা করে দিতে। নিজেকে শান্ত রাখার, নিয়মিত রাখার, তুষ্ট থাকার একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিত নিজের মধ্যে। যে মানুষ শান্ত না, স্থির না, সে মানুষ কি দিশা দেখাতে পারে? দিশা দেখানো তো দূরের কথা, সে মানুষ কি কোনো কাজেই নিপুণ হতে পারে? দক্ষ হতে পারে? পরিস্থিতি যতই ঘোরালো হোক, জটিল হোক - তাকে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনায় বুঝতে হবে। শুধুই আক্রোশ, আস্ফালনকে যদি বেশ কিছু একটা হচ্ছে বলে বোধ করে বসে থাকি তবে নিজেকে ঠকাচ্ছি বুঝতে হবে। আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শান্ত থাকার অভ্যাস বা পরিচর্যাটা হারাচ্ছি। আমরা দুটো ধাপে বাঁচি - এক) ভীষণ অ্যাক্টিভ মোড, ভীষণ সক্রিয়, দৌড়াদৌড়ি, এ কাজ সে কাজ, এ মস্তি সে মস্তি, ফেসবুক টুইটার হোয়াটস অ্যাপ ইনস্টাগ্রাম সুপার অ্যাক্টিভ, সিনেমা ঘুরতে যাওয়া, আউটিং, বাইরে খাওয়া, পার্টি কিম্বা কর্পোরেট পুকুরে নাইতে যাওয়া, এরপর আঁতেল গ্যাদারিং, রাজনীতি গ্যাদারিং, কাব্যিক গ্যাদারিং, গ্যাদারিং এর গ্যাদারিং ইত্যাদি ইত্যাদি। দুই) ল্যাদ খাওয়া, অফ মোড, লো ফিল, ফাস্ট্রু খাওয়া, রিল্যাক্স করা। এর একটু অফ বিট মোড হচ্ছে ইয়োগা করা, মেডিটেট করা, কর্পোরেট গুরুর অত্যন্ত বাকচাতুরী, বাকমাধুরীপূর্ণ বিশ্রম্ভালাপ শোনা। এগুলো একটু সফিস্টেকেটেড মোড। তবে শান্ত থাকার পরিচর্যা কোথায়? রিল্যাক্স করতে, কি উদ্বাহু তাণ্ডব করে বেড়াতে বাইরের উপকরণ লাগে। নিজের মধ্যে শান্ত থাকার মাধুর্য জমিয়ে তুলতে শুধু নিজেকেই লাগে - 'গোটা-আমি'টাকে লাগে। এখন এই 'গোটা-আমি'টাকে পাই কোথায়? সে তো বাজারে, ইন্টারনেটে, অতীতে, ভবিষ্যতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে। তবে? রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন 'আড়াইশোটা' গীত গান ছাড়া অনেক কিছু লিখেছেন, তার মধ্যে একটা বই আছে "শান্তিনিকেতন"। সেখানে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ নিজের ভিতরের দিকে তাকিয়ে সেখানে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার কথা বলা। এখন যদি বলা হয় রবীন্দ্রনাথ বিপ্লব বুঝতেন না, প্রতিবাদ বুঝতেন না, সে আলাদা কথা। তেমন তর্কবাগীশ আমি হয়ে উঠিনি এখনও। সে ক্ষমতাও নেই। কিন্তু এইটা বেশ বুঝি গোলমালটা ততটা বাইরে নয়, যতটা ভিতরে। তাই বাইরে আজ আসুরিক শক্তির এত আস্ফালন। কথাগুলো ক্রমে স্লোগান। স্লোগানগুলো ক্রমে অভ্যাস, ক্লিশে। অভ্যাসগুলো ক্রমে দিশাহীন। তখন চাই একটা উত্তেজনা। হইহই রইরই। শেষে সব শূন্য। শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। তবু এরই মধ্যে কিছু মানুষ স্থির থেকে, দৃঢ়তার সাথে নিজের অবস্থানে অনড়, সেই আশার আলো। বাইরে কোনো কিছুকে গোছাবার আগে, বাইরেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার আগে, নিজের ভিতর সে শান্ত থাকার অভ্যাসটাকে রপ্ত না করতে পারলে একেবারেই কিছু হওয়ার নয়। অসুরকে অসুর হয়ে পাল্লা দেওয়া যায় না, অসুরকে নাশ করতে হলে নিজের ভিতরের শান্ত সমাহিত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী সত্তাটাকে বলশালী করে তুলতে হয়। এ সূত্র পরিবারেও যেমন সত্য, পাড়াতেও যেমন সত্য, দেশের ক্ষেত্রেও সত্য। নইলে অসুরের জয় সেখানেই হবে প্রত্যেককে অসুর করে তোলা। অসুরের তো জোরের অভাব নেই, অভাব বিবেকের। ক্ষুব্ধ, চঞ্চল হৃদয়ে বিবেকের বার্তা এসে পৌঁছায় না, এই তার ধ্বংসের কারণ হয়। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা কথাকে দিয়েই শেষ করি - "প্রতিদিন এসো, অন্তরে এসো। সেখানে সব কোলাহল নিরস্ত হোক, কোনো আঘাত না পৌঁছোক, কোনো মলিনতা না স্পর্শ করুক। সেখানে ক্রোধকে পালন করো না, ক্ষোভকে প্রশ্রয় দিয়ো না, বাসনাগুলিকে হাওয়া দিয়ে জ্বালিয়ে রেখো না, কেননা সেইখানেই তোমার তীর্থ, তোমার দেবমন্দির। সেখানে যদি একটু নিরালা না থাকে তবে জগতে কোথাও নিরালা পাবে না, সেখানে যদি কলুষ পোষণ কর তবে জগতে তোমার সমস্ত পুণ্যস্থানের ফটক বন্ধ। এসো সেই অক্ষুব্ধ নির্মল অন্তরের মধ্যে এসো, সেই অনন্তের সিন্ধুতীরে এসো, সেই অত্যুচ্চের গিরিশিখরে এসো। সেখানে করজোড়ে দাঁড়াও, সেখানে নত হয়ে নমস্কার করো। সেই সিন্ধুর উদার জলরাশি থেকে, সেই গিরিশৃঙ্গের নিত্যবহমান নির্ঝরধারা থেকে, পুণ্যসলিল প্রতিদিন উপাসনান্তে বহন করে নিয়ে তোমার বাহিরের সংসারের উপর ছিটিয়ে দাও; সব পাপ যাবে, সব দাহ দূর হবে।" ~ রবীন্দ্রনাথ (শান্তিনিকেতন)