“সর্বোপরি, পবিত্র ও দৃঢ়চিত্ত হও এবং মনে প্রাণে অকপট হও—ভাবের ঘরে যেন এতটুকু চুরি না থাকে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি তোমরা রামকৃষ্ণের শিষ্যদের কারও ভেতর কোন জিনিষ লক্ষ্য করে থাক, সেটি এই—তারা একেবারে সম্পূর্ণ অকপট। আমি যদি ভারতে এই রকম এক-শ জন লোক রেখে যেতে পারি, তাহলে সন্তুষ্ট চিত্তে মরতে পারব—আমি বুঝব, আমার কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে। অজ্ঞ লোকে যা তা বকুক না কেন, তিনিই জানেন—সেই প্রভুই, জানেন কি হবে। আমরা লোকের সাহায্য খুঁজে বেড়াই না, অথবা সাহায্য এসে পড়লে ছেড়েও দিই না—আমরা সেই পরমপুরুষের দাস। এই সব ক্ষুদ্র লোকের ক্ষুদ্র চেষ্টা আমরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনি না। এগিয়ে যাও। শত শত যুগের কঠোর চেষ্টার ফলে একটা চরিত্র গঠিত হয়।” স্বামী বিবেকানন্দ
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, মন মুখ এক করাই আসল সাধনা। সমস্ত ধর্মগ্রন্থ সত্যপরায়ণ হওয়ার উপদেশ দেয়। বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, চৈতন্য, কবীর, নানক সবারই এক কথা, সত্য সাধনের চাইতে বড় সাধন নেই।
কিন্তু বিশ্বাসের জগত আর বাস্তবের জগতে তো বিস্তর ফারাক। ন্যায়ের মূল্যবোধে বিশ্বাস, ভালোবাসার মূল্যবোধে বিশ্বাস, মঙ্গলময় ঈশ্বরে বিশ্বাস… এ সবের সঙ্গে বাস্তবের অভিজ্ঞতার সাযুজ্য কোথায়?
হচ্ছে না। লিওন ফেস্টিংগার, ১৯৫৭ সালে একটা বই লিখলেন, কগনিটিভ ডিসোনেন্স। কী হবে বাংলায়? চেতনার অসংগতি? না, প্রতীতির অসংগতি? না বোধের অসংগতি?
‘'চণ্ডালিকা” নৃত্যনাট্যে প্রকৃতি তার এই বোধের অসংগতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল….
যে আমারে পাঠাল এই
অপমানের অন্ধকারে
পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে পূজিব না।
কেন দিব ফুল, কেন দিব ফুল,
কেন দিব ফুল আমি তারে--
যে আমারে চিরজীবন
রেখে দিল এই ধিক্কারে।
জানি না হায় রে কী দুরাশায় রে
পূজাদীপ জ্বালি মন্দিরদ্বারে।
আলো তার নিল হরিয়া
দেবতা ছলনা করিয়া,
আঁধারে রাখিল আমারে
বোধের অসংগতি কী সুখকর? না। এবং স্বাস্থ্যকরও না। অহর্নিশি দ্বন্দ্বে বাঁচতে বাঁচতে মানুষ অসংবেদনশীল হয়ে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে যায়। বায়াসড হয়ে যায়। মনের মধ্যে ক্ষোভের উপর ক্ষোভ জন্মায়। নিজের উপর ধিক্কার অন্যের উপর নিষ্ঠুরতা হয়ে বেরিয়ে আসে।
বিখ্যাত উপন্যাস, “ব্রাদার্স কারামোজভ” এ দস্তভয়েস্কি লিখছেন,
"সর্বোপরি নিজেকে মিথ্যা বলার অভ্যেসটা ছাড়ো। যে নিজেকে মিথ্যা বলে আর নিজেই নিজের তৈরি মিথ্যাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে সে এমন একটা জায়গায় এনে নিজেকে দাঁড় করায় যে, সে নিজের মধ্যে, কি নিজের চারপাশের, কোনো কিছুতেই আর সত্যকে আলাদা করে চিনতে পারে না। ফলস্বরূপ নিজের আর অন্যের উপর শ্রদ্ধাবোধ হারায়। যেহেতু সে কাউকে শ্রদ্ধা করতে পারে না, তাই ভালোবাসতেও পারে না, তখন এই শুষ্কতার থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য, স্ফুর্তির জন্য সে নিজেকে নিজের পাশবিক স্বভাব আর বিকৃত উল্লাসের হাতে সঁপে দেয়, সম্পূর্ণ একটা পশু হয়ে ওঠে দিনে দিনে, আর এ সবেরই সূত্রপাত হয় সেই নিজেকে মিথ্যা বলার অভ্যাস থেকে।
এই ধরণের মানুষেরা খুব অল্পেতেই অপমানিত বোধ করে। আসলে অপমানিত বোধ করার মধ্যে তারা একটা আনন্দ পায়, তাই না? কারণ তারা নিজেরাও জানে যে আসলে কেউই তাকে অপমান করেনি, সে নিজেই এই অপমানটা বানিয়েছে, নিজেকে মিথ্যা বলে, অতিরঞ্জিত করে কোন তুচ্ছ একটা শব্দকে তিল থেকে তাল বানিয়ে, কারণ সে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, তার মধ্যে আনন্দ পেতে চায়। যদিও এসবই সে খুব সচেতনভাবে করে, নিজের মধ্যে সব কিছু সম্বন্ধেই সে জ্ঞাত, তবু এই অপমানিত বোধ করার আনন্দটা পাওয়ার জন্য সে মরিয়া, এর মধ্যে সে একটা তৃপ্তি পায় আর এভাবেই তার মধ্যে ধীরে ধীরে সত্য অর্থে বিদ্বেষের ভাব লালিত হতে থাকে।"
প্রাচীনের সঙ্গে নবীনের। আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের। বিশ্বাসের সঙ্গে অভিজ্ঞতার অহর্নিশি বিরোধে এই অসংগতির ভার ক্রমে জমছে তো জমেই চলেছে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যায় লেখা কবিতাও এই অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি।
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।”
এ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যেন সে বোধের অসংগতি থেকে উত্তরণের একটা রাস্তা দেখাচ্ছেন, “সহজ বিশ্বাসে করে তারে সমুজ্জ্বল….সত্যেরে সে পায়, আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে”।
=========
কিন্তু আমাদের বোধের অসংগতি কি এত সহজে যাওয়ার? আমাদের নিজেদের নিজেদের মানসিক গঠন, একের পর এক মোহভঙ্গ….অবশেষে কি এক গভীর বিষাদের দিকে নিয়ে যায় আমাদের? নিজের কপটতায়, নিজের ভণ্ডামিতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে সব যুদ্ধত্যাগ করে মাঝপথে বসে পড়ি?
সংশয় থেকে ত্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মছলনা থেকে ত্রাণ পাওয়া যায় না। সে সত্যকে অস্বীকার করতে শিখে গেছে। মিথ্যা থেকে আরো মিথ্যার দিকে যায় শুধু বাইরের লাভের দিকে তাকিয়ে। সে যখন হারায়, একেবারেই হারায়। সে যখন ভাঙে, একেবারেই ভাঙে।
বোধের অসংগতি থেকে বাঁচার জন্য কেউ স্বেচ্ছা-বধিরতা, কেউ স্বেচ্ছা-অন্ধত্ব নিজের উপর আরোপ করে। একটা ছোটো সংকীর্ণ কমিউনিটি তৈরি করে নেয়। একটা কনফারমেশন বায়াসনেসে অভ্যস্ত করে নেয়। তা-ই দেখে যা দেখতে চায়। তা-ই শোনে যা শুনতে চায়। কিন্তু বোধের অসংগতি থেকে সংগতির রাস্তায় যাওয়ার পথ তো এটা নয়! তবে উপায়?
======
আপাততভাবে যা সত্য বলে মনে হচ্ছে তা ইচ্ছানুরূপ, বিশ্বাস অনুরূপ, ভালোলাগা অনুরূপ না হলেও তাকেই মেনে নেওয়া। সত্যের চাইতে বড় কিছু হয় না। সত্যই আশ্রয়। সত্যই আশা। আলো। জোর। সব কিছুই সত্য থেকে জন্মায়।
অসংগত বিশ্বাস আমাকে কোথাও নিয়ে যাবে না। যদি অসংগতির বোধ হয় আগে সংগতি খোঁজাই সব চাইতে মূল্যবান কাজ। কারণ সত্য দাঁড়িয়ে থাকে সঙ্গতির মধ্যে, বিরোধের মধ্যে না। দিন রাত্রির বিরোধ যেমন দাঁড়িয়ে থাকে আহ্নিকগতির সত্যের উপর। অকপটতাই একমাত্র উপায়। এই অকপট হওয়ার সাধনাই মানুষের বোধের সব চাইতে কঠিন সাধনা। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, যে সমন্বয় করেছে, সে-ই লোক। আমাদের দর্শনে একে বলেছে “সমাধান”। ভাবের সমাধান। চিত্তের সমাধান। বোধের সমাধান। সেকি আপনিই হবে?