কিছু মানুষ ক্রিকেট খেলছে। আমরা মানুষ দেখছি না। আমরা দেশ দেখছি। আমরা দেখছি দুটো দেশ ক্রিকেট খেলছে। আবার তারাই যখন অন্যভাবে ক্রিকেট খেলছে, আমরা দেখছি দুটো রাজ্য ক্রিকেট খেলছে।
কয়েকজন মানুষ ক্রিকেট খেলছে। এটা বাস্তব। দেশ আর রাজ্য জুড়ে দেওয়াটা সেন্টিমেন্ট।
বাস্তবকে সেন্টিমেন্ট লেভেল অবধি নিয়ে যাওয়াটা মার্কেটিং। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ এক মহাস্ত্র। বলা যায় ব্রহ্মাস্ত্র। ব্র্যাণ্ড সেন্টিমেন্ট করার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই মার্কেটিং-এ, বিশেষ করে বাচ্চাদের ব্যবহার করে। এখন ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবোধ এসবও ঢুকে পড়ছে।
আমরা আদতে কতটা বাস্তবে আর বস্তুজগতে বাঁচি? মানুষের চেতনার গায়ে সেন্টিমেণ্টের আবরণ না থাকলে মানুষ মারা যেত। রূঢ় বাস্তবকে সহ্য করা সারা জীবনে বিশেষ কয়েক মুহূর্তের জন্য হয় তো সম্ভব, সাধারণ মানুষের পক্ষে, কিন্তু সর্বক্ষণের জন্য হলে মানুষ পাগল হত।
প্রাচ্যে জ্ঞান ও ধ্যানভিত্তিক যতগুলো দর্শন ও ধর্ম আছে তার প্রধান কথাই হল এই সেন্টিমেন্টকে স্থির রাখার চেষ্টার কথা। বাইরের নানা ঘটনায় সেন্টিমেন্ট যেন অস্থির না হয়। সক্রেটিসের পর পাশ্চাত্যে যে stoic দর্শন শুরু হয়, Epictetus, Seneca, Aurelius প্রমুখেরা যে রাস্তার পথিক, সেখানেও এই একই কথা। ভক্তি সেন্টিমেন্টকে স্থির রাখতে না বলে, বলল একমুখী করতে। কাজটা একই। চেতনার উপর সেন্টিমেন্টের স্তরটা যতটা সম্ভব পাতলা করার। যেখানে চেতনা সেন্টিমেন্টের অধীন হবে না, আবার সেন্টিমেন্টহীনও হবে না। কারণ দ্বিতীয়টা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, অসহনীয়।
এই সেন্টিমেন্টের আবরণের জন্যেই চেতনা কখনও সত্যকে সত্যের মত করে পায় না। চেতনা আর সেন্টিমেন্টের নিটফল আমার বাস্তব। যার ফলে সেন্টিমেন্টহীন হওয়া অসম্ভব মানুষের পক্ষে। যাকে আমরা বলি সেন্টিমেন্টহীন, আদতে সেও আরেকটা সেন্টিমেন্ট। কারোর কারোর আবার সেন্টিমেন্টের নিম্নচাপ হয়। কিছু হয় তো বাইরে ট্রিগার করল, ব্যস তৈরি হল নিম্নচাপ। তাদেরকে আমরা বলি সেন্টিমেন্টাল। যেমন বাতাসের উপস্থিতি যখন বাতাস টের পাওয়ায় আমরা তাকে বলি ঝড়, এও তেমন। আমরা তাকেই বলি সেন্টিমেন্টাল যার সেন্টিমেন্ট বারবার নিম্নচাপের হুমকি দেয়। কারণ বারবার সে ট্রিগারড হয়।
যেমন ধরা যাক, আমি রামবাবুকে শ্রদ্ধা করি। অমুকে করে না। এখন এই শ্রদ্ধা করা আর না করা দুটোই সেন্টিমেন্ট। তাই দু'পক্ষের যখন দ্বন্দ্ব লাগে, তখন তা চেতনার নয়। সেন্টিমেন্টের। মত তৈরি হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। আর বাস্তব অভিজ্ঞতা তৈরি হয় সেন্টিমেন্ট আর চেতনার যুগ্ম রসায়নকে ভিত্তি করে। আমি দেখেছি আমাদের নানা তথাকথিত গবেষণামূলক বই এই দোষে দুষ্ট। যে শ্রদ্ধাহীন সে ভাবছে সে ভীষণ বাস্তবের কাছাকাছি। আসলে সেও যে আরেক সেন্টিমেন্টের আওতায় সে তার কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে হয় ভক্তির অতিকথন, নয় অশ্রদ্ধার সেন্টিমেণ্টে তিলকে তাল করার প্রবণতা। এই নিয়েই যত বই। যত জীবনী। আসলে সেন্টিমেন্ট কখনও উদার হয় না। জ্ঞান উদার হয়। সে জ্ঞান যদি সত্যজ্ঞান হয়।
এর মধ্যে থেকে একটা সরু রাস্তা আসে, সেটা নিজেকে জানার রাস্তা। সবটা নিয়ে। নিজেকে খণ্ড খণ্ড করে না দেখে সবটা নিয়ে যে নিজেকে দেখা তাকে বলে আত্মজ্ঞান। সে কোনো 'মিস্টিক' বা 'অতীন্দ্রিয়' ব্যাপার নয়। একদম খাঁটি ধরাছোঁয়ার মধ্যেকার বস্তু। আমরা যখন কোনো মনোবিদের কাছে যাই সে তো মনোবিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব বুঝতে না রে বাবা, আমরা যাই নিজেকে বুঝতে। এ-ও তাই। আমার সেন্টিমেন্ট, আমার চেতনা, আমার স্মৃতি ইত্যাদি যাবতীয় সবকিছু মিলে যে 'আমি' তাকে সবটা জানার চেষ্টা করলে তবে সেটা জ্ঞান হয়। সত্য জ্ঞানের মধ্যে একটা পারম্পর্য, সংগতি আর সামঞ্জস্য থাকে। তখন দ্বন্দ্ব থেমে যায়। আলো আসে।