অনুভূতির ইচ্ছা জন্মায়। ভালোবাসার অনুভূতির এক ইচ্ছা, ঈর্ষার অনুভূতির আরেক ইচ্ছা। যখন "হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি, ছুটি নে কাহারো পিছুতে... মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই কিছুতে" - সে আরেক ইচ্ছা।
বুদ্ধি বলতে যাকে বুঝি, তার যত জ্বালা, অনুভূতিকে অস্বীকার করবে, সে সম্ভব নয়। কিন্তু অনুভূতিজাত ইচ্ছাগুলো সব তো আর সুবিধার নয়, তখন? তার মহা বিপদ তখন, 'শ্যাম রাখি কি কূল রাখি' অবস্থা। সব ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটালে সভ্য সমাজে থাকা দায়, এদিকে ইচ্ছার গতিরোধ করলে মনের মুখভার। বেশি চাপাচাপি করলে আবার ভবিষ্যতে বিষফোঁড়া হওয়ার ভয়।
এখন এই হাজার হাজার অনুভূতি আর সে হাজার হাজার ইচ্ছার ভবিতব্য কি তবে? গালিব সাহেব তো বলেই বসলেন, এর এক একটা সাধ সাধতেই নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। তা মানুষটার বুকের পাটা ছিল তিনি অমন কথা বললে বলতেও পারেন। কিন্তু আমরা ছাপোষা মানুষ, আমাদের সভ্য হয়ে না চললে যে সব যায়। তবে? এই যেমন ধরেন গিরিশ ঘোষ। যেই না ওর বাড়ির সামনে দুর্গা ফেলল, তিনি কুড়াল দিয়ে দিলেন ফালাফালা করে। নাকি কান্নার ধুয়ো তুললেন না, "এই আমার বাড়ির সামনে দুর্গা ফেলে গেছে... অসভ্য... ইতর" ইত্যাদি।
তো কথা হচ্ছে, যাকে ডিপ্লোম্যাটিকভাবে ঠিক থাকা বলে, এমন মসৃণ মানুষের সংসারে অভাব নেই। তারা চলতে ফিরতে, নাইতে খেতে, কথাতে কান্নায় হাসিতে এক্কেরে একশোতে একশো। অবশ্যি না হয়েই বা উপায় কি? এত ভালোমানুষ যে নই সেটা জানান দিলে তোরা সংসারে টিকতে দিবি? আমার গুষ্ঠীর ষষ্ঠী পুজো করে ছাড়বি না রাতদিন! আর তোরাও যে কি সে আমার জানতে বাকি নেই যদিও, তবু তোরা যেহেতু বেড়াল ঝুলিস্থ রেখেছিস অগত্যা আমিও অসহায়।
উফ, কোথাকার কথা কোথায় এনে ফেললাম। কথা হচ্ছিল ইচ্ছা নিয়ে। ভালো অনুভূতির ভালো ইচ্ছা আর মন্দ অনুভূতির মন্দ ইচ্ছা। আচ্ছা এই ভালো মন্দ কেসটা কি? এর কি নির্দিষ্ট কিছু মাত্রা আছে? উত্তর, নেই। তবে? বলছি।
যদি তুমি পাহাড়ে চড়বে ঠিক করেছ, তবে আঁকা বাঁকা পথটাই তোমার ভালো। আর যদি খাদে গড়াবে ঠিক করেছ, তবে রাস্তার ধারের ওই ঢালটাই তোমার ভালো। মোট কথা যদি বাঁচতে চাও, একরকম ভালো, আর যদি মরতে চাও, আরেকরকম। তুমি বলবে, এইটা কি কথা হল, কেউ মরতেই বা চাইবে কেন? আহা, চাইবে নাই বা কেন? ইচ্ছার গতি অত যদি হিসেবী হবে তবে সে ইচ্ছা কেন হবে, হেডমাস্টার হবে। সেই হল কথা।
তবে ইচ্ছার গতি ইচ্ছার প্রকৃতির উপর নির্ভরালো। এখন এই দুষ্টু ইচ্ছাগুলোর গতি কি হবে তবে? ভালো ইচ্ছাগুলো তো বেশ সেজেগুজে পার্কে, নদীতে, পাহাড়ে, সমুদ্রে বেড়িয়ে আসবে। মন্দ ইচ্ছাগুলোর কি হবে? ওদের কি কবর দেব না চিতায় তুলব? বন্দী করে রাখব না নাইয়ে খাইয়ে পাতালঘরে পুষে রাখব? মানুষ সবটাই করে। নইলে দেখনি শকুনি যেভাবে দুষ্টু লোক, রাবণ সেভাবে কি? কিম্বা মন্থরা যেভাবে দুষ্টু কংস সেভাবে কি? নয় তো বলো!
এখন তবে কথা দাঁড়াল এই, যার যেমন অনুভূতি তার তেমন ইচ্ছা। আচ্ছা অনুভূতি বদলানো যায়? বুদ্ধি, কি বলেন? পারেন? বুদ্ধি হাই তুলে বলল, না না। সে আমি পারি না। তবে শুভবুদ্ধি বলে কি কিছুই নেই? শুভবুদ্ধি তো শুভ অনুভূতির সাথেই আসবে নাকি? একজন লোক ঈর্ষায় জ্বলছে, তার কি আর শুভবুদ্ধি জন্মাবে? কখনও না। তবে উপায়? আছে। বুদ্ধি পারে না, পরিবেশ পারে। চারপাশের পরিবেশটা যদি খানিক বেশি সুস্থ, বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ, বেশি সহযোগিতাপূর্ণ হয় তবে আখেরে সে দুষ্টু ইচ্ছাগুলো কিছুটা হলেও কাহিল হয়। কেমন? যেমন শীতে ডেঙ্গুর মশা কাহিল হয়। ডেঙ্গুর মশার যে ইচ্ছা হয় না তা তো নয়, কিন্তু শীতে পেরে ওঠে না। এই হল কথা। বুদ্ধি বলল, হুম, কিছুটা ঠিক। আমি বললাম, আরে ভাই, আমি তো কিছুটার কথাই বললাম। পুরোটা কে আর জানে? তাই না!