সৌরভ ভট্টাচার্য
25 July 2020
অতি-যুক্তি আর অতি-আবেগ - দুটোই জীবনের পক্ষে বড় ক্ষতিকর। কারণ জীবনটা শুধু যুক্তিও না, শুধু আবেগও না, জীবনটা জীবনই। ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা। অজানা, অচেনার মুখোমুখি হওয়া। আবার চেনা, জানার মধ্যে ঘোরাঘুরি করা। যে মানুষটা আমার কাছে সান্ত্বনা চাইতে এলো, তার দুঃখ, তার শোক, তার ভয় থেকে যে ত্রাণ পেতে এল আমার কাছে, তাকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যুক্তির ধারে ক্ষতবিক্ষত না করে যদি আবেগ দিয়ে শোনা যায় তার কথা, সেটা অনেক বেশি কার্যকরী হয়। কারণ আমাদের জানার সাথে ব্যবহারের কোনো সম্পর্ক সে অর্থে পাকাপাকি নেই। আমি যা জানি তা আমি জানি। আমি যা ব্যবহার করি তা আমি আমার জানা থেকে, যুক্তি করি না। তা করি আমার ইচ্ছা, আমার আবেগ, আমার ভয়, আমার আতঙ্ক, আমার লোভ, আমার ঈর্ষা, আমার স্বার্থ, আমার কাম, আমার চালাকি, আমার ক্ষুদ্রতা, আমার স্নেহ, আমার ভালোবাসা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রবৃত্তি থেকে আমার ব্যবহার আমি করি। সেকি আমার জানার বিজ্ঞাপন না আমার বাধ্যতা? বা আমার স্বভাবের কাছে আমার অসহায়তা? আমার যা কিছু হোক না কেন, সে অন্তত আমার জানা বা যুক্তিজাত নয় সব সময়। তবে কি আমি কখনওই জ্ঞানের দ্বারা, যুক্তিদ্বারা পরিচালিত হই না? হই। তবে এই জ্ঞানও আমার আছে যে আমি সব সময় জ্ঞানের দ্বারা, যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হই না। আমার অনেক ব্যবহারের সাথেই যুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। এই জ্ঞান আমার আছে, আমি যুক্তিহীন সেই সময়ে। কিন্তু তা মিথ্যা নয়। সেই যুক্তিহীনতাই সত্য তখন। যদিও আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনুকূল আচরণ করে তারপর হাজার একটা যুক্তি সাজাই তার পক্ষ নিয়ে। এও আরেকটা চতুর প্রবৃত্তি। কে শিখিয়েছে? আমাদের অতিরিক্ত যুক্তিপ্রবণতার প্রতি লোভ। আমায় রাগী করেছে, অসহিষ্ণু করেছে, উন্নাসিক করেছে, দাম্ভিক করেছে - আমার এই অতিযুক্তি পরায়ণতার সাজ। যেখানেই আমি হেরেছি সেইখানেই আমি আহত পশুর মত ক্ষুব্ধ হয়ে থেকেছি। আমার সেই ক্ষুব্ধতায় সংসারের জীবন স্রোতের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। একপেশে, একঘরে হয়ে পড়ে থাকি আমি কেবল। আমার অতি যুক্তিপুষ্ট অহমিকার মিথ্যা অবাস্তব গোঙানি সহ্য করতে করতে।
এ অভিজ্ঞতা আমাদের সবার। আমাদের সবার এই জ্ঞানটুকু আছেই যে আমাদের আচরণ বেশিরভাগ সময়েই যুক্তি নিয়ন্ত্রিত নয়। যদিও বারবার আমরা বিশ্বাস করতে চাই যুক্তিই মানুষের ব্যবহারের চূড়ান্ত নির্ণায়ক হওয়া উচিৎ। হয় না, এটা যুক্তি না, এটা অভিজ্ঞতা।
তাই যে মানসিকভাবে বিপন্ন মানুষটার পাশে আমি দাঁড়াচ্ছি, আমি যেন এইটা মনে রাখি, তার আমার যুক্তির পাঁচালির শোনার কোনো দরকার নেই। সে যুক্তিপিডিয়া তার মাথাতেও গিজগিজ করছে। তবু সে উঁচুতে উঠলে ভয় পায়, তবু সে নিজেকে অসুন্দর ভেবে কষ্ট পায়, তবু সে নিজেকে ব্যর্থ ভেবে যন্ত্রণা পায়, তবু সে নিজেকে হীন জেনে লজ্জা পায়...এরকম বহু তবু আছে। সব যুক্তির বিরুদ্ধে, যুক্তির বাইরে। কিন্তু সবটাই বাস্তব। মাকড়সা থেকে আমার জীবনহানির আশঙ্কা নেই জেনেও আমি ভয় পাই। আমার যে পরম বন্ধু সে আমাকে যুক্তির পাঁচালি শোনায় না তখন, সে হয় তাকে তাড়ায় নয় মেরে দেয়। কারণ সে জানে আমার ভয়টা অযৌক্তিক হলেও বাস্তব। আমাদের মধ্যে এমন বহু কিছু অযৌক্তিক হলেও বাস্তব আছে। তাকে যুক্তির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে তুলে, তাকে অপদস্থ, অপ্রস্তুত করে তুলে হয় তো আমার যুক্তির লেজ মোটা হয়, কিন্তু আমার বিবেক স্বস্তি পায় না। আমার মানবিক সহমর্মিতা লজ্জা পায়। ভালোবাসায় অতি-যুক্তি এমনই বেমানান, ক্ষতিকর, ঘাতক। নিজের ধারালো যুক্তির সামনে কাউকে দাঁড়াতে না দেওয়াতে, বিশেষ করে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কোনো মানুষকে, বিপন্ন কোনো মানুষকে হেনস্থা করে কোনো বাহাদুরি, কোনো পদক পাওয়া যায় না। শুধু সম্পর্কটাকেই ব্যর্থতায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আমি দেখেছি, নিজের অনেক ভুল শুধরাতে গিয়ে দেখেছি, ভালোবাসা আর ধৈর্যতেই একজন মানুষকে সাহায্য করা যায়। সযৌক্তিক তিরস্কার, ভর্ৎসনা আসলে কোনো কাজেই আসে না। সে আমায় এড়িয়ে যেতে শেখে, লুকিয়ে যেতে শেখে। লাভের লাভ কিছু হয় না। আজও শিখতে চেষ্টা করছি। নিজের হাজার সীমাবদ্ধতায় লজ্জা পাচ্ছি। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছি অতি-যুক্তি আর অতি-আবেগের দুই ভিন্নধারার ফাঁদ থেকে জীবনের স্রোতটাকে বাঁচিয়ে জীবনটাকে শুধু জীবনই করে রাখতে। মানুষ তো অবশেষে মানুষই না?