ন্যায় আমাদের নীতিগত না ধর্মগত। ধর্ম আমাদের বিবেকগত না, আচারগত। আচার আমাদের বিজ্ঞানগত না, অতীত ঐতিহ্যগত। তাই মারতে বা মারের হয়ে সাফাই গাইতে আমাদের অসুবিধা হয় না। আমাদের অবচেতন জুড়ে হাজার বছরের আচারের ভরবেগ, আমি থামাতে চাইলেও থামবে কেন?
আমি জন্মাবধি দেখে আসছি বিজ্ঞান আর আচার-অনুষ্ঠান একসাথেই চলতে পারে। কেন? না ওটা মানতেই হয়, কেন? না ওটা হয়ে আসছে, করলে ক্ষতি তো কিছু হচ্ছে না... অগত্যা যুক্তিবাদী মানুষের ছেলের পৈতের কার্ড পেয়েছি, নাস্তিকতার আলোচনা শুনেছি বক্তার হাতে বিপত্তারিণীর লালসুতো বাঁধা দেখতে দেখতে। এভাবেই বড় হয়েছি। অনেক আচারে হয়ত নিজের অজ্ঞাতেও মাথা নুইয়েছি। পরে ভুল বুঝে সরে এসেছি। আসলে একটা মানুষের গড় আয়ু যদি ধরি সত্তর, সেইটুকু সময়কালের মধ্যে যুগ যুগ সঞ্চিত প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তি পেলেও রুখে দাঁড়ানোর সাহস পায় কোথায়? অনেক সময় যুক্তি না পেলেও সাধারণ বুদ্ধিতে হয়ত কোনো প্রথা মেনে চলার কোনো যুক্তি পায় না, তবু তাকে মানতেই হয়। কারণ আগেই বললাম, এক, প্রথা, দুই, মানলে ক্ষতি কি?
সংশয় জন্মানো আমাদের বিশ্বাসে পাপ। যে কোনো বিশ্বাসের বিপরীতপক্ষ থাকবেই – যারা অবিশ্বাসী এবং অন্য তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাই একপক্ষ গরুর দোহাইয়ে পিটিয়ে মারে, আরেকপক্ষ ঈশ্বরের দোহাইয়ে WTC উড়িয়ে দিতে পারে। অনেকে তা সমর্থনও করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, এটাও বড় সাংঘাতিক কথা। যখন বাংলাদেশে একজন একজন করে মুক্তচিন্তাবিদকে হত্যা করা হচ্ছে, তখন আমার কিছু পোস্টের প্রতিবাদে এমন সব মেসেজ মেসেঞ্জারে ঢোকে, আমি বাধ্য হই বহু বাংলাদেশী বন্ধুকে ব্লক করতে। অথচ তার কয়েকটা পোস্ট আগেই তারা কোনো কবিতায় বা গল্পে অত্যন্ত সুন্দর কমেন্টস করেছেন। কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু নিরুপায় হয়ে সরে এসেছি তাদের থেকে।
আমরা একটা অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এটা মানব সভ্যতার আয়রনি কিনা জানি না, ঠিক যে সময়টা আমরা কোথাও একটা গর্ব করতে শুরু করেছিলাম যে আমরা অনেকটা কুসংস্কারমুক্ত হয়ে এসেছি, ঠিক তখনই সারা পৃথিবীজুড়ে শুরু হল একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী, অসহিষ্ণুতার আবহাওয়া। আজ যদি আবার শুনি পোলিও, স্মলপক্স ইত্যাদি হচ্ছে, তখন আমাদের বৈজ্ঞানিক মহলে যেমন দুশ্চিন্তা, সাময়িক হতাশার ছায়া আসবে, আজ সারা বিশ্বজুড়ে সেই হতাশা আর দুশ্চিন্তার ছায়া বুদ্ধি-বোধ সম্পন্ন নাগরিক মননে। কোথায় ভুল হল? আমরা জানি না। তবে কি এই অসহিষ্ণুতার বীজ তলে তলে তার শিকড় বিস্তার করে চলেইছিল? এখানে একটা কথা মনে হয়।
শিক্ষার যে টেকনিক্যাল দিক সেটা আমরা হয়ত অনেকটা প্রাথমিক স্তর অবধি আনতে পেরেছি, কিন্তু শিক্ষার যে আলোকিত দিক সেটা আনতে আমরা সেই স্তরে ব্যর্থ হয়েইছি। সেই ব্যর্থতার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে তারা যাদের তাতে লাভ। একটা সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা টেনে গোষ্ঠী বিভক্ত করে দিলে অল্পজ্ঞ, আত্মবিশ্বাসহীন শাসকের সুবিধা হয়। শিক্ষার অর্থ যদি সাক্ষরতা হয় তবে তাতে আমরা এগিয়েছি। কিন্তু সেই অক্ষরজ্ঞান তাকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেটাও যখন আমরা স্থির করে দিই, তখন সে শিক্ষার নামে প্রহসন হয়ে ওঠে।
আসলে আমাদের শাসকের একটা ভাবমূর্তি ছিল। আমাদের আশা ছিল সেই সঙ্কীর্ণ ভাবমূর্তি থেকে তারা বেরিয়ে এসে একটা বৈচিত্রপূর্ণ ভূখণ্ডের সার্থক শাসক হয়ে উঠবে। কারণ তার আগে আমরা একটার পর একটা দুর্নীতি আর তার প্রশ্রয়ে ক্লান্ত। কিন্তু তা হতে হতেও হল না। আমাদের চেতনার গভীরে একটা দাগ স্পষ্ট টানা হতে শুরু করেছে, আমরা বুঝছি আমরা একটা বিশেষ কোডের মাধ্যমে শাসিত হচ্ছি, উন্মুক্ত বিচার বিবেচনায় নয়। আলোচনা হচ্ছে না যে তা না, আলোচনার যুক্তিরা আগেই সেজে বসে আছে, আমাদের সামনে শুধু MCQ, হয় এটা নয় ওটা, বেরোবার উপায় নেই। একটা সাদা পাতা দেওয়ার সাহস আর কোনো পক্ষ আমাদের দিচ্ছে না। এমত অবস্থায় যে যা বলছেন আমরা শুনছি, আমাদের উপায় নেই। কারণ আমাদের একটা পুরোনো রোগ আছে, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি দুর্বলতা। তার কতটা ত্যাজ্য আর কতটা গ্রাহ্য এখনও তা নিয়ে সম্যক ধারণা তৈরি হয়নি আমাদের। আমরা বেদান্তে পদার্থবিদ্যার জটিল সূত্রের আভাস পাই, আবার শনিবারে নিরামিষ খাওয়ার পক্ষে যুক্তিয় শাস্ত্রীয় আর অতিবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও খুঁজে পাই। দুজনেই জানে তারা প্রাচীন নির্ভুল অতিজাগতিক অনুশাসনের শাসন কর্তার বিধান অনুসারে কাজ করে চলেছে। সব ধর্মেই তাই, এক একভাবে। রাজনৈতিক মহল আমাদের এই আদিব্যাধির ব্যবহারের কৌশল জানেন। কেউ বলছে এরা তোষিত হচ্ছে, কেউ বলছে ওরা তোষিত হচ্ছে। কিন্তু একটা দেশের সামগ্রিকতায় যে কোথাও এরা-তোরা-আমরা-ওরা নেই, এই কথাটা হঠাৎ করে খুব কম গুরুত্ব পাচ্ছে।
একটা সুড়ঙ্গপথ ক্রমে সরু হতে হতে কোন দিকে এগোচ্ছে বুঝছি না। কথা ছিল রাজপথ হবে, হচ্ছে সুড়ঙ্গ। অক্ষরের রঙ বদলাচ্ছে, কথার সুর পাল্টাচ্ছে, কোনো একটা বিশেষ ব্যবসায়ীর কব্জায় প্রায় গোটা ভারতের চলমান দূরভাষ মহল, এটা কোন দিকে এগোনোর সঙ্কেত? ভারত তুমি সাবধানে রেখো ব্যালট তোমার!
সৌরভ ভট্টাচার্য
25 July 2018