মেয়েদের মত করে হাঁটিস না… মেয়েদের মত করে কথা বলিস না… মেয়েটার কেমন মদ্দা মদ্দা ভাব… ওরকম হিজড়েদের মত হাততালি দিস না…
এগুলো আমাদের সমাজের স্বীকৃত সতর্কীকরণ বাণী। রাস্তায় যেমন “ধীরে চালান, সামনে স্কুল”... ”ধীরে হর্ণ বাজান, সামনে হাস্পাতাল”... লেখা থাকে, এও তেমন। ফেসবুকে একজনের ভিডিও দেখছিলাম, তিনি একটা গানের স্কুলের বিজ্ঞাপন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, তার হোয়াটস অ্যাপ, ফোনে রাতবিরেতে যখন তখন কল, ভিডিও কল আসা শুরু হয়েছে, বন্ধুত্ব চাইছে, জেন্ডার আইডেণ্টিটি নিয়ে প্রশ্ন করছে। কারণ সে মানুষটার কথাবার্তা, সাজপোশাক তার চিরাচরিত ধারণা থেকে কিছুটা আলাদা।
এটা হয়। আমি পড়াতে গিয়ে দেখেছি, বহু ছেলেরা প্রশ্ন করে “ওদের কি থাকে?... দুটোই থাকে?... ওদের বাচ্চা হয় না?... ওদের সেক্সলাইফ হয় কি করে”... এরকম গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন আসে।
সমস্যাটা জটিল কিছু নয়। হিজড়ে বলতে তারা ছোটোবেলা থেকে দেখে আসে - ট্রেনে, রাস্তায় টাকা চাইতে আসা কিছু অন্যরকম মানুষের দল, বাড়িতে বাচ্চা হলে আসা সেই মানুষের দল, যারা অন্যভাবে, অন্যভঙ্গীতে, অন্যভাষায় কথা বলে। যা তাকে শেখানো সামাজিক ভদ্রতার মানদণ্ডের বাইরে। আর অবশ্যই তার সেই বয়সে সমাজকে বিশ্লেষণ করে দেখে তাদের ওরকম হওয়ার কারণ বোঝার সামর্থ্য থাকে না। বাড়ির বড়দেরও সে বিষয়ে জানানোর আগ্রহ থাকে না। তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাচ্চাদের “ওদের” থেকে দূরে সরাতেই তৎপর থাকে। যাতে কোনো ‘কুপ্রভাব’ শিশু মনে না পড়ে।
কিন্তু কৌতুহল থেকেই যায়। ওরা কিরকম, ওরা কারা। একটা মজার কথা দেখুন ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতিতে লিঙ্গের সীমারেখা কিন্তু ততটা একরোখা নয়। বিশেষ করে আমাদের অধ্যাত্মিক জগতে। যখন আমরা বলছি রামকৃষ্ণদেব দীর্ঘদিন শাড়ি পরে মেয়েদের মত সেজে সখীভাবে সাধনা করেছেন, এমনকি তাঁর মেয়েদের মত সাজ দেখে মথুরবাবু পর্যন্ত চিনতে পারেননি, তখন কিন্তু আমাদের মানতে অসুবিধা হচ্ছে না। মহাপ্রভুর জীবনী লিখতে গিয়ে ওনার মধ্যে গোপীভাব, রাধাভাব নিয়ে ব্যাখ্যা শুনতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু নিত্য জীবনে অন্যভাব দেখাতে গিয়ে আমাদের যত সংস্কারে বাধে। এমনকি তপন সিংহ মহাশয়ও ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ সিনেমায় ‘নুসু’ কে নাকি পুরোদস্তুর নারী চরিত্র দেখিয়েছেন পড়লাম ক’দিন আগে।
একদিন মানুষের পক্স হলে তাকে নগরের বাইরে ফেলে আসা হত। কুষ্ঠ হলে একঘরে করা হত। আজ কম হয়। আজও ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা হয়, দুদিন আগেই হয়েছে, তবে কম। এবং সে ঘটনা অবশ্যই কলকাতার বুকে হবে না, হলে হবে প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে শিক্ষার আলো স্কুল অবধি কোনো রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলেও জীবন অবধি এসে পৌঁছায়নি।
শিক্ষার আলো কোনো একটা জেনারেশান থেকে আরেক জেনারেশানে আত্তীকরণ হতে সময় লাগে। কোনো পরিবর্তনই রাতারাতি হয় না। সেটা আশা করা মূর্খামি। আমাদের সমাজেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে, আরো অনেক পরিবর্তন হওয়া বাকি। কিন্তু যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে সেগুলো শুরু তো কেউ না কেউ করেছেন। শুরুর কাজটা নিশ্চয়ই খুব সুখের ছিল না।
আমাদের যেটা প্রথম করতে হবে, মানুষের লিঙ্গভেদ প্রকৃতিতে যে নানা বৈচিত্ররূপ ধরে আছে সেটা অনেক ছোটো বয়েস থেকে সিলেবাসে আনা। আপেল কেন মাটিতে পড়ে বা আলোর কটা রঙ বা সালোকসংশ্লেষ কি করে পাতায় হয় - এ সব জানা দরকার। তবে সে সবের থেকে বেশি দরকার সমাজে নানা মানুষ কেন নানারকম হয়, আর প্রত্যেকের যে সমান মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে, সে শিক্ষাটা তাকে দেওয়া। মজার কথা কি জানেন, আমাদের বাচ্চাদের প্রাণীরাজ্যের শ্রেণীবিভাগ কি বিশদে পড়ানো হয়, মেরুদণ্ডী, আদ্যপ্রাণী, মোলাস্কা, একাইনোডার্মাটা, স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু মানুষের বৈচিত্রগুলো পড়ানোর দরকার আমরা মনে করি না। সে বিষয়টা ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা আছে দায়সারাভাবে, কিন্তু বিশদে তাকে বোঝানোর চেষ্টা নেই।
একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, এবারের মাধ্যমিকে যখন অভিব্যক্তি অধ্যায়টা বাদ পড়ল, আমি মনে মনে বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। কারণ মানুষের সভ্যতার ইতিহাস যতটা সেই আগুন জ্বালার কাছে কৃতজ্ঞ তেমনই তার বোধের ইতিহাস ডারউইন মহাশয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের বহু ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণা এই একজন মানুষ দূর করেছিলেন তার প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বে। যে কারণে আজও বেশ কিছু পাশ্চাত্য স্কুলে এই অধ্যায়টাকে অস্বীকার করা হয় বলে আজও রিচার্ড ডকিন্সের মত বরিষ্ঠ প্রাণীবিজ্ঞানীকে স্কুলে স্কুলে গিয়ে তাদের নিয়ে প্রমাণ করানোর চেষ্টা করতে হয় যে ঈশ্বর সাতদিনে জগত সৃষ্টি করেনি, জগতের প্রাণীকূল সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘদিনের বিচিত্র গতিপথে। অথচ হাজার হাজার ছেলে মেয়ে পাশ করে যাবে মাধ্যমিক এই মানুষটার নাম শুধু না, এই মানুষটার যুগ বদলানো ইতিহাসটা না জেনে, যা হয় তো তার ব্যক্তিগত অনেক ভ্রান্ত ধারণাও দূর করত ভবিষ্যতে। আমি নিজে আমার ছাত্রছাত্রীদের আলাদা করে, কিছুটা জোর করেই অধ্যায়টা পড়িয়েছি, তাদের আগামী জীবনের কথাটা ভেবে। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস অভিব্যক্তি তত্ত্ব বুঝলে অনেক অন্ধবিশ্বাস মূল থেকে উৎপাটিত হয়ে যায়।
মূল কথায় আসি, আমরা আমাদের পঠনপাঠনকে আরো একটু পরিণত করতে পারি না এই স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের যুগে এসে? আমরা মানুষের যৌনতার প্রকৃতি নির্মিত নানা বৈচিত্রকে ব্যাখ্যা করে, তাকে যথাযথ মর্যাদায় স্বীকার করে নেওয়ার রাস্তা দেখিয়ে আমরা সমাজটাকে সব মানুষের আরো বাসযোগ্য করে তুলতে পারি না? কাউকে যাতে নিজেকে বিকিয়ে, নিজেকে লুকিয়ে বাঁচার রাস্তা খুঁজতে না হয় সে কথাটা ভাবতে পারি না? সময় কিন্তু এসে গেছে শুধু না, দেরি হয়ে যাচ্ছে বলা যায়। “ওদের সঙ্গে ওরকম করতে নেই, ওরা ভগবানের অভিশপ্ত” এমন কথাও তো শুনেছি, এ সবই বিজ্ঞানরহিত চিন্তাভাবনার ফল। আর কবে শুধরাবো আমরা?