Skip to main content

 

মানুষ নৌকায় চড়ে, পারে হবে বলে, এ বিশ্বাস। সে জানে যে পারে নাও পৌঁছানো হতে পারে, মাঝনদীতে কত নৌকা ডুবে গেল, সেকি জানে না? জানে তো, সে বাস্তব। তবু সে নৌকায় ওঠে।

 

অতুলপ্রসাদ সেন লিখছেন,

কী আর চাহিব বলো, হে মোর প্রিয়,

তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।

বলিব না রেখো সুখে, চাহ যদি রেখো দুখে,

তুমি যাহা ভালো বোঝ তাই করিয়ো।

শুধু তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।

যে পথে চালাবে নিজে, চলিব, চাব না পিছে;

আমার ভাবনা প্রিয়, তুমি ভাবিয়ো।

শুধু তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।

দেখো সকলে আনিল মালা– ভকতি-চন্দন-থালা,

আমার যে শূন্য ডালা, তুমি ভরিয়ো।

আর তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।

 

গানটা কি আকুলভাবে গেয়েছেন কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়। কত ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি, শুধু তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিও।

      শিব মানে তো মঙ্গল। মঙ্গল শব্দটা আসলে কি? বিশ্বাস। মানুষ বিশ্বাসে বাঁচে, বাস্তবে না। বাস্তবে বাঁচে পশু। মানুষ পারে না। আছে বা নেই, মঙ্গল বা অমঙ্গল, আশা বা নিরাশা - কিছু একটাকে বিশ্বাস করে তাকে দাঁড়াতেই হয়। কিন্তু বিশ্বাসহীন কেউ হতে পারে না। তবে সে সুস্থ থাকতে পারে কি করে?

      ত্রিযামা সিনেমায় ছবি বিশ্বাস বেশ প্রসন্নমুখে বসে নিজের তীর্থযাত্রার গল্প বলছেন। এমন সময় উত্তমকুমার মানে ওনার ছেলে এসে উদ্বিগ্নতার সঙ্গে জানালো ব্যাঙ্ক ফেল করেছে, অর্থাৎ সমস্ত জীবনের সঞ্চয় শূন্য।

      ছবি বিশ্বাস একবার, ও, বলে আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। উত্তমকুমার অস্থির হচ্ছেন, রেগে যাচ্ছেন বাবার এই নির্বিকারভাব দেখে। তখন ছবি বিশ্বাস বললেন, যিনি দেন, তিনিই নেন, আমার ভালোর জন্যেই নেন, এইটুকু বিশ্বাসেই আমাদের লাভ।

      অতুলপ্রসাদ সেনের এই মঙ্গলকে খুঁজতে চাওয়ার আকুলতা একি প্রাগৈতিহাসিক? সে যুগের কথা বলে এড়িয়ে যাব? তাই কি হয়? মানুষ যখন একা, তখনই সে নানা ভাবনায়। ভাবনায় ভাবনায় সংঘাতে ভালো থাকা যায়? "রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল, তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল"... সে সংঘাতের মধ্যে সত্যিই তো মঙ্গল নেই। আমার কুটকুটে অহম না বুঝলেও, আমি তো বুঝি। রাত জেগে নিজের মনের মধ্যে বিরুদ্ধ ভাবনাদের সন্ধিস্থাপন যজ্ঞকর্ম কি কম বড় একটা কাজ? হয় তো তার আশু কোনো ফল হাতেনাতেই পাওয়া যায় না, কিন্তু দুর্দিনে বোঝা যায়। সন্ধিস্থাপন দরকার। খুব দরকার একটা বোঝাপড়া। ভাবনাদের সংহতিকরণ।

      হয় কিভাবে? চাইলেই হয়। একবার দীর্ঘক্ষণ ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি ভাবছিলাম স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না, তবে এইটুকু বুঝছিলাম ভিতরে কিছু একটা চলছে। আলোড়ন চলছে। কিচ্ছু ভাবতে চেষ্টা করলাম না। নিশ্চুপ রইলাম। ধীরে ধীরে মন শান্ত হতে শুরু করল। এতটাই শান্ত হল যে নিজের অস্তিত্বকেই যেন হারিয়ে ফেলছি। না সুখ, না দুঃখ, না ভাবনা, না দুশ্চিন্তা, না উদ্বেগ।

      তখন বুঝলাম মনকে যদি নিজের মত ছেড়ে দেওয়া যায় তবে মন নিজে নিজে একটা সাম্যাবস্থা তৈরি করেই নেয়। একটা বলকে গড়িয়ে দিলে যেমন সে গড়াতে গড়াতে একটা স্থির জায়গায় নিজের থেকেই দাঁড়িয়ে যায়, এও তেমন। তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালে অকারণে অনেক শক্তির অপচয়। তাকে স্থির করে রাখতে চাইলে সে স্থির থাকে না। তাকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় চড়িয়ে রাখলেও সে সুখকর নয়। তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলতে পারলে, কিছুটা উদাসীন থেকে যেতে পারলে সে নিজের মত করে নিজেকে গুছিয়ে নেয়।

      সকালে চায়ের কাপ নিয়ে বসেছি। দুটো বাড়ির মাঝখানের ফাঁক দিয়ে আকাশটা দেখা যাচ্ছে। কি অপূর্ব রং। মনে হচ্ছে এক গামলা নীল কেউ গুলে রেখে গেছে। শাসন করে গেছে, কেউ যেন এদিকে না আসে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি, কি রঙ, কি স্নিগ্ধতা, আহা!

      আর স্নিগ্ধতা, দেখতে দেখতেই কোথা থেকে একপাল কালো মেঘ হুড়মুড় করে রঙের গামলায় পড়ল লাফিয়ে। সব রঙ তছনছ। গামলা উল্টে একাকার। মাঠ ঘাট বাড়ি মুহূর্তেই আশ্বিনের বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করে দিল।

      এই যে এতবড় একটা অনর্থ ঘটে গেল, কাকে অভিযোগ করব? কার কাছে নালিশ জানাব? কেউ তো কোনো আপত্তি জানালো না এই এমন সুন্দর ব্যবস্থার মধ্যে অব্যবস্থা ঘটে গেল বলে! এত বড় সংসারে ক্ষুব্ধ হল কে? শুধু আমার মন। তার হাজার নালিশ, হাজার অভিযোগ।

      কিন্তু সে মনকে যদি ছাড়াধরার বাইরে রেখে দিই, সে বুঝে যায় তার অভিযোগ শোনার কেউ নেই, তার কাঁদুনি শোনার কেউ নেই, তার নালিশ জানানোরও কেউ নেই। সে শান্ত হয়। তার উপদ্রব কমে।

(ছবি - Aniket Ghosh)