Skip to main content

ভাষা ব্যষ্টির অভিজ্ঞতাকে সমষ্টির সামনে নিয়ে আসে।

    মত ও অভিজ্ঞতা দুটো আলাদা শব্দ। মত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত। যেমন রসগোল্লা মিষ্টি। এ সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা। কিন্তু রসগোল্লা সব চাইতে ভালো মিষ্টি --- এ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। মত। "আমার মনে হয়" --- এই কথাটা বেঁচে আছে, ভাষা আছে বলেই। নইলে আমার কি মনে হয়, তাকে পৃথকভাবে জানার বা জানানোর উপায় ছিল না।

    ব্যষ্টি অভিজ্ঞতা আর সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা জায়গা আছে --- গোষ্ঠীগত অভিজ্ঞতা। কোনো একটা দল যখন ভালো খেলছে, তখন সেই দলের সমর্থকদের যে সুখকর অভিজ্ঞতা, তা গোষ্ঠীগত অভিজ্ঞতা। গোষ্ঠী তখন একটা ব্যষ্টির মত আচরণ করছে। মানুষের মধ্যে এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে অন্যকে আনার প্রবণতা আছে। দল ভারী করা। আমার যেমন অভিজ্ঞতা হচ্ছে তোমারও হোক। এ বাসনা থেকে নানা দলের উৎপত্তি। রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, খেলা, শিক্ষা, পেশা ইত্যাদি কোন জগতে না এই দলের অস্তিত্ব আছে। আমাদের অভিজ্ঞতা একরকম হোক।

    ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিল নিয়ে যে গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে যে টান, তা ভালোবাসা। রোমান্টিক না। ভ্রাতৃত্ববোধের। তার বাইরে ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে আরেক অনুভবের ডাক পড়ে, করুণা। তোমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার সঙ্গে না মিললেও আমি তোমায় মেনে নিচ্ছি, স্বীকার করছি, এ হল কনসিডার করা।

    তবে সত্য কি? সেকি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা? একজন লেখক যখন সাল-তারিখ-পরিসংখ্যান ইত্যাদি দিয়ে কোনো কিছু বর্ণনা করেন, আমরা ধরে নিই তিনি যা বলছেন তাই ঘটনা, মানে ইংরাজিতে যাকে বলি 'ফ্যাক্ট'। কিন্তু আমরা কতটা নিশ্চিত হতে পারি যে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সে ঘটনাকে রঞ্জিত করছে না? এই কারণেই কোনো ঐতিহাসিকই সর্বজনগ্রাহী হন না। কারণ আমরা কেউ-ই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে বেরোতে পারি না সর্বাংশে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমাদের সংস্কারে তৈরি করে ব্যক্তিগত সত্যের বুনিয়াদ। ব্যক্তিগত বুনিয়াদ আমাদের বাকি চিন্তাভাবনাকে নিয়মিত করে। সেখানে আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই।

    তবে কি একেবারেই স্বাধীনতা নেই? আছে। আমাদের চিন্তার স্রোত যখন সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় তখন আমাদের অবস্থাকে আমরা বলতে পারি অনেকটা স্বাধীন অবস্থা। চিন্তা শুরু হলেই বিচার আসবে। তুলনা আসবে। বাসনা সক্রিয় হবে। চিন্তার নানা রঙে আবার সব কিছু রাঙিয়ে যাবে।

    তবে প্রশ্ন আসে, বিজ্ঞানের জায়গা কি তবে?

    সেখানে যতক্ষণ তা তাত্ত্বিক ততক্ষণ তা অনেকাংশে এক। অন্তত যতটা প্রমাণ নির্ভর। কিন্তু যখনই তা প্রকল্প নির্ভর বা ব্যবহারিক তখনই আবার নানা 'স্কুল অব থট'। চিকিৎসাক্ষেত্র এর সব চাইতে বড় উদাহরণ আমাদের অভিজ্ঞতায়। যখন আমরা সেকেন্ড ওপিনিয়ন, থার্ড ওপিনিয়নের কথা ভাবি তখন আমরা ওই একই ঘূর্ণিতে আটকে --- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে নির্ভর করব? কার সিদ্ধান্তে হ্যাঁ-তে 'হ্যাঁ' বলব। এ এক সংকট। এরকমভাবে অর্থনীতি, পরিবেশ বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে দেখব এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জন্মানো নানা পূর্ণ বিরোধী, আধা বিরোধী ইত্যাদি দলের অবস্থান।

    জীবন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। কিছুটা এর-ওর-তার সঙ্গে মিলল, কিছুটা মিলল না --- এই নিয়ে সমাজ। এই নিয়ে গোষ্ঠী। এই নিয়েই উপগোষ্ঠী।

    আমার সুখ, আমার দুঃখ, আমার আনন্দ, আমার সার্থকতাবোধ, আমার বিশ্বাস, আমার উপলব্ধি, আমার ভালোবাসা, আমার ঘৃণা, আমার দ্বেষ, আমার মোহ, আমার বাসনা, আমার লোভ…. এ তালিকা দীর্ঘ। এত সব নিয়ে এই যে 'আমি', এই যে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার শিকল পরানো আমার 'আমি', তার কতটা বাস্তব? কে বলবে? কে আছে যে নৈর্ব্যক্তিক অভিজ্ঞতায় অরঞ্জিত? ভারতের দর্শন কল্পনা করেছিল এক সত্তাকে - বলেছিল সে নির্গুণ ব্রহ্ম। বুদ্ধদেব বললেন, সব শেষ করে ফেলো, নির্বাপিত হোক। জড়বাদী বলল, সুখ চাই। আর কিছু চাই না। আমায় মত্ত থাকতে দাও আমায় নিয়ে। তারপর যা হবে হোক।

    শেষে সব এসে ঠেকলো সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাঁচিলে। স্বপ্নের মধ্যেও সে। রমণ মহর্ষি জিজ্ঞাসা করছেন, তোমার যাবতীয় অভিজ্ঞতার দ্রষ্টা কে? উত্তর খোঁজো।

    তবে এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাঁচিল পেরিয়ে, আমার 'আমি'কে পেরিয়ে যাই কোথায়? দাঁড়াই কোথায়?

    স্বামীজি একটা সূত্র দিলেন। স্বার্থশূন্য হতে চেষ্টা করো। জ্ঞানে, প্রেমে, আচারে, ব্যবহারে নিজেকে ভুলে যাও। একেবারে কি সম্ভব সে? স্বামীজি বললেন, না। তোমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্যের অভিজ্ঞতা মিলুক না মিলুক, তোমার অস্তিত্বের মধ্যে অন্যের অস্তিত্বের মান্যতা জাগুক। আমার থাকা যে অনেক কিছুর থাকায় থাকা হয়ে ওঠে, একে স্বীকার করো। পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে দেখতে শেখো। তবে জানবে আমার একার অভিজ্ঞতাই শেষ কথা নয়, আমার একার টিকে থাকাই শেষ কথা নয়, সবার মধ্যে এই যে আমি সে-ই আসল। যা অভিজ্ঞতা নয়। যা বাস্তব নয়। যা ধারণা নয়। যা সময়। আমরা প্রত্যেকে এক টুকরো সময়ের বুদবুদ।

    আমাদের অভিজ্ঞতার ধারাও তো সেই বুদবুদ ঘেরা গল্পমালা। ব্যস, আর কি? তার চাইতে অভিজ্ঞতা থাক। অনুভবী হও। অনুভবের স্রোতে চিন্তার জাল না বিছালে অভিজ্ঞতার শিকল জন্মায় না। অনুভব বয়ে যাক, চিন্তা জাল না ফেলুক। অনুভব সদা বর্তমান। চিন্তার জালে আটকানো অভিজ্ঞতা তো ক্রমশ অতীত থেকে অতীতের দিকে যাওয়া। সে চাই না।


"চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি।

চেয়ো না চেয়ো না তারে নিকটে নিতে টানি॥

রাখিতে চাহ, বাঁধিতে চাহ যাঁরে,

আঁধারে তাহা মিলায় মিলায় বারে বারে--

বাজিল যাহা প্রাণের বীণা-তারে

সে তো কেবলই গান কেবলই বাণী॥

পরশ তার নাহি রে মেলে, নাহি রে পরিমাণ--

দেবসভায় যে সুধা করে পান।

নদীর স্রোতে, ফুলের বনে বনে

মাধুরী-মাখা হাসিতে আঁখিকোণে,

সে সুধাটুকু পিয়ো আপন-মনে--

মুক্তরূপে নিয়ো তাহারে জানি॥" 

~ রবীন্দ্রনাথ।