"একটাও বৃক্ষকে উৎপাটিত না করে, অরণ্যকে ধ্বংস করে ফেল। অরণ্য হতেই ভয়ের উৎপত্তি হয়"। ~ বুদ্ধ
শূন্যস্থান বলে কিছু কি রাখা যায়? যায় না। বাড়ি দীর্ঘদিন ফাঁকা রেখে গেলে ঝুল, পোকামাকড়ে ভরে থাকে। তেমনই আমাদের মন-বুদ্ধি। যেটা ধরো স্পষ্ট করে বুঝল না, অমনি সেই ফাঁকা জায়গাটাকে কল্পনায় ভরে নেবে। তার জন্য যে একটা সচেতন চেষ্টা করতে হবে তা নয়। নিজের অজান্তেই করে নেবে। আমি নিজেও স্পষ্ট করে বুঝব না কতটা আমার সত্যিকারের জ্ঞান আর কতটা কল্পনা। কল্পনা বলো, অনুমান বলো, সবই এক।
এখন দেখো, এই কাজটা তো আমাদের স্বভাবসিদ্ধ কাজ। এমন তো নয় কোনো বিশেষ রাজার আদেশে, কিম্বা কোনো সরকারের নির্দেশে, কিম্বা বিশেষ কোনো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আমাদের এমনটা হয়। এ আমাদের জন্মলব্ধ ব্যাপার। তাই সেই আদিকাল থেকে আমরা যেটাই স্পষ্ট জানতাম না, স্পষ্ট বুঝতাম, অথচ আমাদের সেই ক্ষেত্রে একটা জানার, বা বোঝার তাগিদ এসেছে, আমরা কি করতাম, ফস করে কল্পনা করে নিতাম। এক্কেবারে সত্যিকারের মত করেই।
দিন যত এগোতে লাগল, মানে এই আমাদের পৃথিবীতে থাকার দিন আর কি, সেটা যত এগোতে লাগল, আমাদের দেখা-শোনা বাড়তে লাগল, সেই সাথে আমরা “ভাষা” বলে একটা বেশ লেখা-বলার ব্যাপার দাঁড় করিয়ে ফেললাম, হিসাবনিকাশ করতে শিখলাম, তত আমাদের জ্ঞানের জমি বাড়তে লাগল। আর কল্পনার জমি কমতে লাগল। শুরুতে শুরুতে পৃথিবীর কয়েকটা জায়গায় অবশ্যি এই নিয়ে বেশ মারামারিও হয়েছিল। মানে কল্পনার লোকেরা নিজেদের কল্পনাটাকে এমন সাধারণ সত্য মানতে শুরু করেছিল যে তার বিরুদ্ধে যেই না সত্যজ্ঞানের লোকেরা কিছু বলতে গেল, ব্যস, অমনি হাঁইহাঁই করে তেড়ে গেল। একে তাকে মেরে, কারাগারে বন্দী করে কি সব ছ্যা ছ্যা কাণ্ড করে বসল। গ্যালিলিও, ব্রুনো এদের নাম আছে না?
আমি একটা কথা ফস করে লিখে ফেললাম দেখলে, ‘সাধারণ সত্য।’ কিরকম বলো তো, এই যেমন ধরো আমার বর্ণান্ধতা আছে। আমি একটা বিশেষ রঙ দেখতে পারছি না। সে রঙটাকে বলছি, নেই তো! কথাটা মিথ্যে নয়। রঙটা সত্যি সত্যিই আমার কাছে নেই। সেটা আমার ব্যক্তিগত সত্য। কিন্তু সাধারণ সত্য তো নয়! মানে সবার সত্য তো নয়। এই যেমন যদি বলি বাংলা ভাষাটাই সব চাইতে মিষ্টি ভাষা। কথাটা সত্য। কিন্তু সে আমার কানের জন্য, প্রাণের জন্য সত্য। সাধারণ সত্য তো নয়। তেমন আমি যদি বলি, এই ধরো, কৃষ্ণই হল একমাত্র ভগবান, কি আল্লাহ হল একমাত্র, বাকি সব মিথ্যা, সে-ও হল তেমন নিজের নিজের জন্য সত্য, কিন্তু তাকে সাধারণ সত্য বানাতে গেলেই ভুল হবে। বড্ড ভুল। ওই রামকৃষ্ণদেব বলছেন না, “সবাই ভাবে আমার ঘড়িটাই ঠিক চলছে। বাকি সবারটা ভুল।” কি দামী কথা ভাবো। আবার বলছেন, “সবাই নিজের নিজের মতটাকেই বড় করে বলেছে।” এও কী খাঁটি ঠিক কথা।
এই আমি আবার কোথায় চলে এলাম। দাঁড়াও আবার শুরুর কথাটায় যাই। তো যেটা বলছিলাম। আমাদের দেখা-শোনা, ভাষা নির্ভর যুক্তিবুদ্ধি-অঙ্কেটঙ্কে যত মাথা খুলতে লাগল, তত আমাদের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের ঠাঁই ঠাঁই লাগতে লাগল। তো এমন সময় একজন মানুষ জন্মালেন না? সক্রেটিস। কি পদবী ছিল মনে নেই। ঘোষ, কি মুখুজ্যে, কি বারুই, পাল তো হবে না। কিছু একটা ওদের দেশের হবে। তো, সেই মানুষটা বলল, এই দেশে আমিই একমাত্র জ্ঞানী। কারণ, এক আমিই জানি যে আমি কিছুই জানি না।
এইখানে আবার এই সক্রেটিসের সঙ্গে আমাদের রামকৃষ্ণ ঠাকুরের খুব মিল। দুজনেই একই কথা বল তো। আসলে আমাদের অহমিকা যখন বলে আমি এটা, কি সেটা জানি না, তার সঙ্গে একটা দু:খ থাকে। ইস, ও জানে, বিশ্বশুদ্ধ লোক জানে, আর আমি জানি না! কিন্তু আমাদের প্রজ্ঞা যখন নিজের সীমানাকে জেনে বলে, আমি কিছুই জানি না, তার মধ্যে দুঃখ, রাগ, ক্ষোভ কিছুই থাকে না। সে কথা সে আনন্দের সঙ্গেই বলে। কারণ ওটাই সত্যজ্ঞান।
তো সক্রেটিস আমাদের এই এক ছটাক সত্যজ্ঞানের সঙ্গে কয়েক বালতি কল্পনা-অনুমান মেশানো কেসটা বুঝতে পেরেছিল। তাই যখনই সক্রেটিস প্রশ্নবাণে সামনের “আমি সব জানি” মার্কা লোকগুলো কোনঠাসা করে দিত, তারা পালাবার পথ পেত না। সক্রেটিস আমাদের কল্পনা-অনুমানকে প্রশ্নের ফুঁ দিয়ে দিয়ে এমন জ্বাল দিত যে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যেত একটা ভুল তথ্যের উপর কল্পনার মেঘ জমিয়ে সে বাঁচছিল।
তো ভ্রমটা তবে কী? কল্পনা, আর অনুমান কি ভ্রম তবে?
না। ভ্রম হল কল্পনা-অনুমানকে সত্যজ্ঞান হিসাবে জানার অবস্থা। সে অবস্থাটা বাইরে থেকে যতটা সরল মনে হয়, আদৌ তো তা নয়। আমাদের কত ধ্রুবজ্ঞান যে এই সংকরে তৈরি তা কেউ-ই জানি না আমরা।
দেখো, কল্পনা-অনুমানের একটা সুবিধা হল সে আমার ইচ্ছার পরোয়া করে। কিন্তু বাস্তব সেটা করে না। বাস্তব মানে সাধারণ সত্য। এখন বর্তমানে আমাদের এই স্বভাবের দোষটা নিয়ে ভীষণভাবে ছেলেখেলা করছে মিডিয়া। আমি নিন্দা করতে চাইছি না। কিন্তু তাদের অনেকেই ভয়েই হোক, কি আর কোনো স্বার্থের জন্যেই আমাদের আধপাকা গল্প, অর্ধসত্য গিলিয়ে যাচ্ছে। আমি নিন্দা করছি না, কিন্তু একটা চালাকি তো ওরা করছেই না! সব মানুষেরই দুর্বলতা থাকে নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবার। আমি যা জানি সঠিকটা জানি, সত্য আমার দিকেই, এরকম একটা ভাব থাকা মানে তো একটা ক্ষমতার কথাই হচ্ছে নাকি! নলেজ ইজ পাওয়ার। কথাতেই তো আছে না? তো এরা সবাই মিলে এমন একটা গল্প আমাদের বোঝাতে চাইছে, যে আমরা স্পষ্ট করে বুঝতেই পারছি না।
এখানে একটা খেলা অবশ্য আছে। যখনই দেখবে কেউ তোমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছে, মানে তুমি যাই প্রশ্ন করো, সে শুধু তোমাকে যে করেই প্রত্যয় জাগানোর চেষ্টা করছে, তখনই বুঝবে কোথাও কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। কারণ একটাই, জগতে শতকরা একশোভাগ কনভিন্সড হওয়ার মত ব্যাপার প্রায় কিছুই নেই। স্কেপটিক না হলে সত্যের ধারেকাছেও যাওয়া যায় না। অনেক স্পষ্ট কথার মধ্যে অস্পষ্ট সত্যের একটা আভাস থাকে, সেই আভাস নিয়েই আমাদের চলতে হয়। অন্তত আশু আর কোনো উপায় আমরা জানি না। অনেক জ্ঞানী মানুষ এই জন্যে গোটা জগতকে ছলনার জাল ইত্যাদি বলেছেন। কিন্তু যো হ্যায় সো হ্যায়। এই নিয়ে কান্নাকাটি করে কি হবে?
আর একটা কথা বলেই থামি। ভ্রম দাদা অনেক আছে। জগত জোড়াই ভ্রমের কারাখানা। কিন্তু ভ্রম আপনি জন্মানো, আর ভ্রমকে বেশ কায়দা করে জন্ম দেওয়ানোর মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। বাঁচার উপায় কি? সক্রেটিস। প্রশ্ন করতে শেখা। সব উত্তরকে প্রশ্ন করতে শেখা। সব ধ্রুবকে প্রশ্ন করতে শেখা। সব নিশ্চিতকে প্রশ্ন করতে শেখা।
এত কথা বললাম, কারণ মিডিয়ার বাজার এখন গরম। যত ভোটের দিন এগোবে আরো গরম হবে। এখন তো আবার ইউটিউব খুললে অনেক স্বনির্ভর, স্বাধীন মিডিয়াও আসছে। ভালোই কাজ করছে তারা অনেকেই। বেশ অল্প বয়েসী ছেলেমেয়েরাই করছে। তো এই সময় আমাদের প্রশ্ন করার অভ্যাসটাকে আবার করে ঝালিয়ে নিতে হবে। কোনটা স্বয়ম্ভু ভ্রম আর কোনটা বাজারি ভ্রম, সেটা বুঝে নিতে হবে।