Skip to main content

ধ্যানের জগত আর কাজের জগত। নানকের শিক্ষায় এই দুই জগতকে মেলাবার বাণী। সংসার শুধু ধ্যানের জগতে না, আবার শুধু কাজের জগতেও না। এই দুইয়ের মধ্যে সঙ্গতির পথ নানকের শিক্ষায়। ঈশ্বরের নামগান করলেই কি মুক্তি? নানকের উত্তর, না। শুধু তা দিয়ে হয় না, হুকুম মেনে চলো। কিসের হুকুম? সৎ পথে জীবিকার আর সেবার।

      জীবিকা ব্যতীত মানুষের জীবন চলে না। কিন্তু সে যেন কাউকে প্রতারিত করে না হয়। আর সেবা? নানক দর্শনের শিক্ষা --- দাতাকে মনে রাখো। মনে রেখো, সংসারে দাতা একজনই হয়, যিনি এক, নিরাকার, নির্বৈর, নির্ভয়। সেবা দাও, অন্ন দাও, শ্রম দাও। কেন দেব? কারণ আমার দেওয়ার স্রোতের সঙ্গে সেই এক পরম এক-এর দানের ধারা মিলবে তবে। আমি পথ রুদ্ধ করলে, সেদিকের উৎসমুখও বন্ধ হবে।

      এ হল তত্ত্ব। চিত্তের শুদ্ধি হোক নামে আর কর্মে। চিত্তে আমি একা। সংসারে আমি অনেকের মধ্যে। অনেক মানে বৈচিত্র। বৈচিত্র মানে বিরোধের আশঙ্কা। বিরোধের অবসানে মঙ্গল।

      আজ কৃষকের সঙ্গে রাজশক্তির ঘোরতর বিরোধ। যারা নিয়ম বানান আর যারা সেই নিয়মের আওতায় পড়েন – এর মধ্যে বিরোধ জেগেছে। যারা নিয়ম বানিয়েছেন সে নিয়ম কতটা কৃষকের স্বার্থে আর কতটা মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর স্বার্থে – সে উত্তর স্পষ্ট নয়। আর স্পষ্ট নয় বলেই একপক্ষের সঙ্গে আরেকপক্ষের বিরোধ চরমে।

      গণতন্ত্রে নেতা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হন, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হন না। যিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন, তিনি বৃহত্তর জনগণের স্বার্থে নিয়ম বানাবেন --- এই ন্যায়ের পথ। রাজা প্রজাদরদী হতেও পারেন, না-ও পারেন। তিনি জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নন। তিনি স্বীয় ক্ষমতায় শত্রুকে পরাজিত করে, নিজের প্রবল শক্তিতে জনগণের উপর নিজের রাজশক্তি কায়েম করেছেন। তাই তা একনায়কতন্ত্র। তাই কিম নামক রাজা করুণা প্রদর্শন করলে সে দেশের মানুষ তা উপরি পাওনা বলে দেখে। তার খামখেয়ালিপনাকেই প্রাপ্য বলে মানে। কিন্তু নেতার প্রজাদরদী হওয়াটা কোনো বিকল্প না। ওটাই প্রথম শর্ত। তোমাকে আমরা আমাদের শক্তির, ক্ষমতার নেতৃত্বের ভার দিয়েছি, এই জন্যে না তুমি প্রবল বলশালী বলে, সে বল যদি এসে থাকে তবে তা আমাদের মিলিত সমর্থনে; আমরা তোমায় নির্বাচিত করেছি শুধুমাত্র এই জন্যে যে তুমি আমাদের সঠিক দিশায় নিয়ে যাবে, আমাদের সবার স্বার্থের কথা মাথায় রেখে।

      কৃষকের এ আন্দোলন হঠাৎ করে আজকে নয়, যেদিন থেকে নতুন নিয়মের ধারা প্রকাশিত হয়েছে সেদিন থেকে। কিন্তু শুরু থেকেই তা নিয়ে রাজশক্তির কোনো গম্ভীর, আন্তরিক পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি, না তো আমাদের আমোদ আর উচ্চনিনাদ গল্পপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলোর কোনো ধারাবাহিক উল্লেখ পেয়েছি। সে আন্দোলন ক্রমে প্রবল হতে শুরু করেছে। রাজশক্তি বল প্রয়োগ করে তা ঠেকিয়ে রাখার উপায় খুঁজলেন প্রথমে। তারপর কথা বলার প্রস্তাব এলো। কোনো গণ আন্দোলনকেই শুরুতে উপেক্ষা করলে তার ফল ভালো হয় না, এ উদাহরণ আমরা হালে অনেকবার দেখেছি। উপেক্ষা করলে দুর্বলের জোর কমে, সবলের জেদ বাড়ে। উপেক্ষায় মিথ্যা নিজের অস্তিত্বসংকটে হীন হয়ে পড়ে; সত্য আরো ক্ষিপ্র, আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

      তবে ভারতের বাকি কৃষকরা এতে সেইমাত্রায় কেন যোগ দিচ্ছেন না? যেমন চাষ-আবাদের ক্ষেত্রে যে রাজ্যের নাম প্রথম আসে সে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। কেন আমাদের রাজ্যের কৃষকের এই উদাসীনতা, কেন তারা আন্দোলনে নেই, এর উত্তর আজানা। তারা কি তবে কেন্দ্র সরকারের প্রস্তাবিত আইন নিয়ে সন্তুষ্ট? জানি না। এই নিয়ে কোনো সমীক্ষা বা আলোচনা আমার চোখে পড়েনি এখনও।

      কোনো মানুষকে বা শ্রেণীকে রাজনীতি বা ধর্মের রঙে রাঙিয়ে দেখাটা অসম্পূর্ণ দেখা। আদতে আছে দুই শ্রেণী – এক শোষক, দুই শোষিত। কম ক্ষমতাশীল আর বেশি ক্ষমতাশীল। বেশি ক্ষমতাশীল হলেই যে সে শোষক হবে তার কোনো অর্থ নেই, কিন্তু সে সম্ভাবনা অস্বাভাবিক নয় সে ইতিহাস বারবার জানিয়েছে।

      মানুষের ধর্মবোধ আছেই। সে ধর্মবোধ অর্থে জগত কি করে সৃষ্টি হয়েছে, বা স্বর্গস্থ পিতার বর্ণনা না। সে ধর্মবোধ বলতে বুঝি মানুষের ন্যায়ের বোধ। নানক যখন বলেন, পরমাত্মার তুষ্টির একমাত্র রাস্তা তাঁর হুকুম মেনে চলা; সে হুকুম বলতে তিনি কোনো সঙ্কীর্ণ নীতির বোঝা চাপিয়ে মানুষকে অপমান করেন না। সৎপথে, সহমর্মিতায় বাঁচার কথা বলেন। জীবন প্রতি মুহূর্তে শিক্ষা দেয়। সে শিক্ষাকে সৎ চিত্তের পাত্রে ধারণ করে, সৎ উদ্দেশে চালিত করে যেন সত্যি অর্থে ‘শিখ’ হতে পারি, সেই শিক্ষাই নানকের শিক্ষা। তাই আজ যে ছবি সারা বিশ্ব দেখল যে, মারমুখী রাজার পেয়াদার সামনে খাবার পাত্র হাতে সেই কৃষক দাঁড়ান যাকে মারতেই সেই পেয়াদা খানিক আগে কুণ্ঠিত হননি, তখন সে নানকের শিক্ষায় সত্য অর্থে গুরুমুখী; মনমুখী নয়। এর আগেও নানা দুর্যোগে শিখদের সেবাব্রতের উদাহরণ সারা বিশ্ব দেখেছে। কারণ নানকের শিক্ষা ভারতের সে প্রান্তের মানুষে মানুষে ছুঁয়েছে। বাংলায় মহাপ্রভুর পর আপামর সব শ্রেণীর বাঙালিকে প্রভাবিত করেছেন এমন বাঙালি ধর্মের জগতে কাউকে আমার চোখে পড়ে না। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আন্দোলন অনেকটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল, আজও আছে। সেই অর্থে লোকনাথ বাবা বাঙালির ঘরে ঘরে এলেও সেখানে কোনো আত্মশুদ্ধির ব্রত নেই, সে লক্ষ্মীপুজোর মত আত্মস্বার্থেই পুজিত।

      মানব সভ্যতায় প্রথম ও প্রধান ঋণ কৃষকের কাছে। সেই কৃষকের পা যদি ক্ষেত থেকে রাজদরবারমুখী আজ তবে তা চিন্তার। তাকে উপেক্ষা করার অর্থ সভ্যতার মূলকে উপেক্ষা করে বৃক্ষের পাতায় জল সিঞ্চন। আজ রামের প্রতি আগ্রহ দেশে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। রামভক্তকূলের মনে থাকা উচিৎ সীতাকে ভারতবর্ষ পেয়েছিল মাটি থেকে কর্ষণ করতে গিয়ে, এমনই লেখেন আদিকবি। সেই সীতার উপেক্ষার ফলও আদিকবি দেখিয়েছিলেন।

      আজ গুরু নানকের জন্মদিনে আমার একান্ত প্রার্থনা, কৃষকদের ক্ষোভ, অসন্তোষ সুরাহা পাক। সীতার অপমান নতুন করে আর না হোক। সীতা যদি ভারতের উর্বর মাটির রূপক হন, তবে তা যেন এমনই সুজলা সুফলা থাকে, কৃষকের তৃপ্তিতে। তবে আমার মুখে যে অন্ন উঠবে তাতে রক্ত লেগে থাকবে না। গুরু নানক এক ধনী কপট ব্যবসায়ীর দ্বারা প্রদত্ত দান আপন ধী দৃষ্টিতে গরীবের রক্তমাখা দেখেছিলেন এবং প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আমার দেশের অন্ন শুদ্ধ হোক, কোনো দীর্ঘশ্বাস না লেগে থাকুক তাতে, এই প্রার্থনা।