ছল চাতুরী শিখতে হয় না। সে মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলোর মধ্যে একটা। একটি ছেলের আর্থিক অবস্থা খারাপ। সে পড়তে এসেছে। তার মা অনুরোধ করলেন একটু দেখতে। দেখা হল। মাস তিনেক বাদে খোঁজ পাওয়া গেল, সে আরো একজনের কাছে একই বিষয় পড়তে যায়, অর্থের সম্পূর্ণটা দিয়েই। এদিকের ছাড়, ওদিকে ব্যবহার হয়ে গেল। এক ঢিলে দুই পাখি। আরেকটি উদাহরণ, একজন একদিন পড়তে এলো না। তাদের সচ্ছল অবস্থা। মা বাবা বললেন, তার ভীষণ জ্বর। পরেরদিন খবর পেলাম সে একজন এমন স্যারের খোঁজ পেয়েছে যে তাকে ডাক্তার না বানিয়ে ছাড়বে না। এক পাড়ায় বাড়ি বলে তারা জ্বরের অজুহাত ছাড়া হয়তো অন্যকিছু ভাবতে পারেনি; এ অবশ্য আমার কল্পনা। আমি কাউকে কিছু বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিই না যে। আমার বাধে।
ছোটো-ছোটো এরকম নানা ছলচাতুরী নিয়ে চলা তো আমাদের পাথেয়। রামকৃষ্ণদেব জীবন সার্থক করার উপায় বলতে গিয়ে বলছেন, মন মুখ এক না করলে উপায় নেই। বলছেন, কপটতা ছাড়ো। তুলসীদাস বলছেন, ছোড়িয়ে কপট চতুরাই।
এত সোজা? আমাদের আচার আচরণে নানা বেশে কপটতা যে! কপটতা ছাড়লে সমাজে বাঁচা যায় নাকি?
শম্ভু মিত্র নাটক শেখাচ্ছেন। বলছেন, এই ধরুন আপনার বাড়িতে একজন কেউ এলেন, আপনি চান না সে আসুক বা আপনি তাকে পছন্দ করেন না, তবু আপনি হেসে তাকে আপ্যায়ন করেন না? এ অভিনয়। আমরা সারদিন অভিনয় করি। ওটা আমাদের রপ্ত করতে হয়।
শম্ভু মিত্রের কথাটা সত্যি। কিন্তু এই সামাজিক অভিনয়ের কারণ তো কিছু থাকবে? তার কারণ একটা আছে। কি কারণ?
কারণ আমাদের স্বভাব। আমাদের স্বভাবের সবটুকু কি আলোকিত? সবটুকু কি ভালো? না। আমাদের স্বভাবের যেদিকটা বর্বর, যেদিকটা অসভ্য, যেদিকটা কুৎসিত, সেদিকটাকে নিয়ে তবে কি করব? আমরা এত যুগের সামাজিক জীবনযাপন করতে করতে দেখেছি আমাদের স্বভাবের কিছুদিক সমাজের জন্য ভালো, কিছুদিক ভালো নয়। আমরা ভালো দিকগুলোকে উৎসাহিত করেছি, চর্চা করার সুযোগ দিয়েছি। শিক্ষা, ধর্ম, নীতি ইত্যাদির মাধ্যমে সহবত শেখাতে চেয়েছি।
কিন্তু কুৎসিত দিকটা? সে তো আমি চাইলেই যাবে না। তবে? তাকে ঢেকে রাখা ছাড়া উপায় কি? একজন মানুষ তার চিত্তের সমস্ত মল নাশ করে সমাজে এসে বাঁচবে এতটা আয়ু কি আছে? কিম্বা সেদিকটাকে যে সম্পূর্ণ নির্মূল করা যাবে তারই বা কি গ্যারান্টি আছে?
অতএব আমরা আমাদের কুৎসিত, বর্বর, অসংস্কৃত দিকটাকে আচ্ছাদিত রেখে তাকে আমল না দিয়ে বাঁচতে শিখেছি। তবে রবীন্দ্রনাথের 'পৃথিবী' কবিতার মত সে কি মাঝে মাঝেই শৃঙ্খল খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না? পড়ে তো। সে তার আশপাশকে ক্ষতবিক্ষত করে একাকার কাণ্ড করে। সত্য-মিথ্যা, শুভ-অশুভ সব গুলিয়ে ফেলে সুপ্ত আসুরী শক্তি জেগে ওঠে। সংসারে দুই বাস্তব, আসুরী শক্তি আর দৈবী শক্তি।
মহাত্মা গান্ধী একটি লেখায় লিখছেন, ব্যাসদেব ও বাল্মিকী - এমন দুই শুদ্ধ আত্মা, সংস্কৃত, শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন কবিও দুই মহাকাব্য লিখতে গিয়ে যুদ্ধকে এড়াতে পারলেন না। যুদ্ধ, সংঘাত, সংঘর্ষ হবেই।
কথাটা কি খাঁটি সত্য। আমাদের প্রাচীন মানুষেরা মানুষের মধ্যের আসুরী শক্তির বীজ খুঁজতে গিয়ে ষড়রিপুর কথা বলেছেন। যার মূল বলতে গিয়ে বলেছেন মোহ। তুলসীদাসী রামায়াণে কাকভূশণ্ডীর সঙ্গে গরুড়ের কথোপকথন নিয়ে উত্তরকাণ্ডের কিছুটা অংশ। সেখানে কাকভূশণ্ডী বলছেন মানু্ষের মোহ সব পাপের মূল। মোহ কি? না সত্যকে মিথ্যা বলে বা মিথ্যাকে সত্য বলে জানা। এককে অন্য ভেবে ভুল করাকে বলে মোহ। আমরা জানি আমার জানা সত্য নয়। কিন্তু বাস্তবকে এড়িয়ে অনুরাগ আর দ্বেষের রঙে রাঙিয়ে দেখলে আমার সুখ। কাউকে ভালো, কাউকে মন্দ বানিয়ে আমার মোহের সংসার। আজ যেই মুখে তার শত সহস্র প্রশংসা করছি, কাল সেই মুখেই আবার নিন্দা করব। আবার পরেরদিন তার স্তুতি গাইব। মোহ এমনই চঞ্চল, ভঙ্গুর, ভীত, অভিমানী। তাই তাকে নিয়ে আমাদের নাস্তানাবুদ হওয়ার শেষ নেই। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, লোক না পোক। লোকনিন্দাকে উপেক্ষা করার ইঙ্গিত শুধু নয়, প্রশংসাকেও উপেক্ষা করার শিক্ষা। প্রশংসার লোভ বড় নীচু করে দেয় মনকে। মন দাস হয়। তাকে তাড়াতে পারলেই নিন্দা বেশিদূর অবধি মনের গভীরে কাজ করতে পারে না।
তবে ছল চাতুরী আর স্বভাবের কুৎসিত দিককে আড়ালে রাখার ইচ্ছা তো এক হল না। কেউ পোশাক পরে আছে বলে তাকে কি কপট বলা ঠিক হয়? এও তেমন। আমার মনের কদর্য দিককে সামনে এনে বেড়ানোতেই কি আমার সততা? তবে নিজের জীবনের লুকানো পাপ, অপরাধগুলোকে স্বীকার করে সোচ্চারে বলতে আমাদের এত বাধে কেন? রাগ, আক্রোশকে যতটা স্পষ্টভাবে বলি, নিজের হাজার একটা পাপ, অপরাধকে ঢেকে রাখি কেন? সেই বেলায় আমার সাংঘাতিক সততার ইচ্ছা কোথায় যায়? মহাত্মা গান্ধী নিজের আত্মজীবনীতে নিজের এক একটা অপরাধ বিনা জাস্টিফিকেশান লিখে গেছেন। সত্যের জোর সেইটাই।
ছল চাতুরী আর সামাজিক অভিনয়ের মধ্যে পার্থক্য এইখানেই। ছলচাতুরীর একটা উদ্দেশ্য থাকে। মতলব থাকে। স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টা থাকে। সে স্বার্থ যতই সুক্ষ্ম হোক না কেন। সামাজিক অভিনয়ের মধ্যে আমাদের নিজেকে নিয়ে এক বিড়ম্বনা থাকে। ভালোকে টিকিয়ে রাখার এক দায় থাকে। নইলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'লাগিয়ে দিত তুর্কিনাচন'। এর মধ্যে দিয়ে গেলেই জীবনের সার্থকতা। এখন সার্থকতাও তো নানা রকমের। নিজেকে সত্য করে তুলে? না নিজেকে নিয়ে নিজের যে তুমুল মোহ, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায়? সময়ই তার উত্তর দেয়।