(এই লেখাটি পড়ার পর যারা আমায় আনফ্রেণ্ড করতে চান, সানন্দে করুন। প্লিজ বোকা বোকা তর্ক জুড়বেন না। আমার অভিজ্ঞতায় সত্য যে বেশে প্রতিভাত আমি তাতে দায়বদ্ধ। কাল যদি এর বিপরীতটা সত্যি বলে মনে হয়, তাও বলব, দ্বিধা করব না।)
বিশ্বাস জন্মানো আর বিশ্বাসে জন্মানো - দুটো আলাদা কথা। ইংরাজীতে illusion, delusion বলে দুটো আলাদা শব্দ আছে। Illusion অর্থে দাঁড়ায় মায়া, যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। আর Delusion অর্থে দাঁড়ালো ভ্রান্তি - মিথ্যা বিশ্বাসকে আঁকড়ে বাঁচার প্রবণতা, বাস্তব সে বিশ্বাসের নানা বিপরীত উদাহরণ দেখলেও।
আরেকটা ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করতে চাই – violence. এর কোনো সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ জানা নেই আমার। এবার আসি মূল কথাটায়। বিশ্বাস।
বিশ্বাস মানুষের চিত্তে একলা জন্মায়। মানুষের যতগুলো চিত্তবৃত্তি আছে তার মধ্যে একমাত্র বিশ্বাসই একলা দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখে। বুদ্ধির প্রমাণ-যুক্তি লাগে। অনুভবের একটা উৎস তথা উদ্দীপক লাগে। বিশ্বাসের কিছু লাগে না। এইখানেই তার জোর আর এইখানেই সে ভয়ংকর হতে পারে। অন্যদিকে এই নির্ভরতাই বুদ্ধি আর অনুভবের সীমাবদ্ধতা আবার তাদের প্রয়োগশীলতা।
কোনো কাজের প্রারম্ভের বাঁশিটা বাজে বিশ্বাসের হাত ধরে। তারপর তাকে এগিয়ে নিয়ে চলে যুক্তি আর অনুভবের স্বচ্ছতা। সে কলম্বাসের দেশ আবিষ্কারই হোক, কিম্বা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার। এক নতুন দেশ থাকবেই - এই বিশ্বাস কলম্বাসকে ঘর ছাড়া করেছিল, অন্যদিকে নিশ্চই এর কোনো কারণ থাকবেই এবং যা অনুধাবনযোগ্য - এই বিশ্বাসই নিউটনকে ভাবতে প্রবৃত্ত করেছিল। মূল বিশ্বাস।
সেরকমই একটা বিশ্বাস - জগতের একজন স্রষ্টার উপর বিশ্বাস। একজন নিয়ন্তার উপর বিশ্বাস। জগৎনীতির কোনো একজন প্রেরক-রক্ষকের উপর বিশ্বাস। ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জয়-পরাজয়, পাওয়া-না পাওয়া, ত্যাগ-ভোগ ইত্যাদির জটিলতায় কোনো এক দায়িত্বপরায়ণ অতি-মানুষী অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস।
এই বিশ্বাসগুলো একা জন্মায়। কিন্তু বোধ হওয়ার পর সে বুঝতে পারে তার সেই বিশ্বাসের একটা প্রতিষ্ঠিত রূপ আছে। যাকে সবাই ধর্ম বলে। প্রথমত সে মেনে নেয়। এই মেনে নেওয়াটা সহজ হয় কারণ এই বিশ্বাসের বোধটা সে নিয়ে জন্মিয়েছে। যেমন সংখ্যা, আকার, রঙ, সুর ইত্যাদিকে মনের মধ্যে ধারণ করার বৃত্তি সে নিয়ে জন্মেছে, এও তেমনি।
অভিজ্ঞতা বাড়ে, তার মনের ভিতর তার চিন্তার পটভূমিটা পাল্টে পাল্টে যেতে থাকে। সে এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসের দিকে যায়। এক -ism থেকে আরেক -ism বলা যায়, কিন্তু কোনো ism ছাড়া সে বাঁচতে পারে না, কারণ ওটা তার মূল প্রবৃত্তিগুলোর প্রথম প্রবৃত্তি।
আমার এই আলোচনার কেন্দ্র তাও নয়। এগুলো তো প্রাককথন মাত্র। আমার কথাটা হল - বিশ্বাস না, বিশ্বাসকে ব্যবহার করা। আজ যে সমস্যাটা সভ্যতার সব থেকে বড় সমস্যার আকার ধারণ করছে তা হল – আতঙ্কবাদ। সমস্যাটার মূল কারণ ধর্মবিশ্বাস না, ধর্মবিশ্বাসের ব্যবহার। আমি ইচ্ছাকৃতেই 'অপব্যবহার' শব্দটা বলছি না, কারণ যে কোনো বিশ্বাসের যে কোনো ব্যবহারই অপব্যবহার। আমি যদি আপনার সেই আদিম বিশ্বাসে আঘাত এনে প্রমাণ করতে পারি যে অমুক নদীতে অমুক তিথিতে ডুব দিলে আপনার উপর সেই সর্বশক্তিমান প্রচণ্ড খুশী হবে, তবে আপনাকে এও বোঝাতে পারি অমুক ধর্মের উপাসকদের হত্যালীলায় মাতলে সর্বশক্তিমান তোমার উপর অত্যন্ত প্রসন্ন হবেন। আপনি বলবেন, প্রথমটা নিরীহ, কিন্তু পরেরটা ভয়াবহ। আমি বলব দুটোই ভয়াবহ, একটার ক্ষতির মাত্রা কম, আরেকটার ক্ষতির মাত্রা তীব্র। কারণ দুটোতেই ব্যবহার কথাটা আসছে, বিশ্বাসকে ব্যবহার, অন্য অর্থে violence.
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যবহার করলে তার ক্ষতির পরিমাণ ওই মাত্রায় পৌঁছায় না, যা তার বিশ্বাসকে ব্যবহার করলে হয়। কারণ বিশ্বাসে সে আদিম কিন্তু বুদ্ধিতে সে আধুনিক। আমি বহু ধর্ম্মমত, বহু গুরু-অবতার-আচার্য্য পড়ে এটুকু বুঝেছি তার মধ্যে ফাঁকির অংশটা অনেক বড়। তার মোদ্দা একটা কথাই হল বিশ্বাসের উপর manipulation. 'আমি জানি, তুমি জানো না' - এ কথা বস্তুজ্ঞানের ক্ষেত্রের মানা যায়। অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি সবের ক্ষেত্রে মানা যায়, কিন্তু এই যখন বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আসে? অর্থাৎ 'আমার বিশ্বাস ঠিক, তোমারটা বিশ্বাসটা এসো ঠিক করে দিই' তখনই এলো প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা।
একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। কোনো একজন মানুষ, যিনি গুরু, তিনি আপনাকে আমাকে সে অর্থে চেনেন না, জানেন না অথচ তিনি একটা ঘরে আপনাকে আর আপনার মত আরো বহু মানুষকে নিয়ে গিয়ে একটা সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করলেন, ব্যস, সব হয়ে গেল। এবার আপনি বছরের পর পর বছরের ওটি পুনরাবৃত করে যান, কেউ খোঁজ নিতে আসবে না আপনার উন্নতি না অবনতি হচ্ছে, কেউ জানতে চাইবে না ওই শব্দবন্ধটাতেই আপনার যাবতীয় তৃষ্ণা মিটল কিনা? ওটিই আপনার প্রকৃতির সাথে সঠিক অনুপানে গেল কিনা?... কেউ জানতে চাইবেন না। আপনি শুধু পুনরাবৃত্তি করতে থাকবেন, তাতে ধীরে ধীরে আপনার মধ্যে একটা অবশেসান তৈরি হবে, অন্য অর্থে আপনি চাইবেন যেন আপনার মধ্যে সেই অবশেসানটা তৈরি হয় যাতে করে আপনি কঠোর বাস্তবটা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও পালাতে পারেন, তারপর দল তৈরি করবেন, আপনার বিরোধীদের মনে মনে করুণা করবেন, যদিও বাইরে বাইরে একটা সর্বধর্মসমন্বয়ের মুখোস রাখবেন, কারণ ওটা মার্কেটে চলছে সবচাইতে বেশি এখন। কিন্তু কোনোদিনই সমজ্ঞান করতে পারবেন না। কারণ আপনার অর্জিত বস্তুটাই যখন আপনার কাছে ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা তখন অন্যের পথ হয় আপনার কাছে ঈর্ষার কারণ নয়ত করুণার।
এটা ভায়োলেন্স। আপনি মেনে নিচ্ছেন কারণ আপনার হাতে অপশান নেই। ঠিক এরই চূড়ান্ত ভয়ংকর রূপ হল ওই জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো। তাদের বিশ্বাসগুলোও ওরকম ভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। হতেই থাকবে, কারণ প্রতিবাদ করার মত শুদ্ধ বিশ্বাসী সত্তা কই? আপনি এক রকম অবসেশান চান, সে আরেক রকম, অবশেষে সবটাই সেই অবসেশানের উপর দাঁড়িয়ে। ওদের বাঁচিয়ে রাখার, মদত দেওয়ার বিত্তশালী মানুষের অভাব নেই। কারণ কুরুক্ষেত্রটা হয়েছিল কৌরবদের জন্য না, যুধিষ্ঠির, ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্রের মত ক্ষমতাধর, শক্তিশালী মানুষগুলো চুপ করেছিল বলে। আমরা চুপ থাকব। কারণ আমরা ঘুম থেকে জাগতে চাই না। আমাদের দুর্বলতায় সুড়সুড়ি দেওয়া লোক আমরা ঠিক খুঁজে বার করে নেব, যারাই জাগার কথা বেশি বলবে তাদের নামে পূজোর ব্যবস্থা চালু করে আচ্ছা সে প্রতিশোধ নেব। সন্ন্যাসীর গান সেলুট দেখব, তিনি কোনদিন কি মোজা পরতেন, কি অসম্ভব ভালো কথা বলতেন, কবে কোথায় জন্মেছিলেন, হেঁটে ছিলেন, চুল কামিয়ে ছিলেন সে ফর্দ মুখস্থ করব। ওগুলো আমার জীবনচর্চা। যারা ওসব করবে না তাদের ভীষণ ক্ষতি হবে ভয় দেখাব। যেমন ইদানীং শুনলাম, অত্যন্ত শিক্ষিত, ধর্মপ্রাণ, ঈষ্টনিষ্ঠ একজন মানুষের কাছে, অমুক সময়ে অমুক মন্ত্রে দীক্ষা নিইনি বলেই আমার মা মারা গেছেন, আমার পরিবারে একটার পর একটা দুর্যোগ এসেছে। এটাও ভায়োলেন্স।
একজন অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ লেখিকা আমায় ফ্রেণ্ড রিক্যোয়েস্ট পাঠালেন। আমি বিনা সন্দেহে আপ্লুত হয়ে তাকে গ্রহণ করলাম। সাথে সাথেই তিনি আমার একটা লেখার কমেন্টস বক্সে গিয়ে লিখলেন, রামকৃষ্ণ মিশনে জাতপাত মানা হয় না। আমি বললুম, তবে কুমারী শুধু বামুনের মেয়ে হয় ক্যান? উনি এড়িয়ে গেলেন। তারপর দেখি আমার কোনো লেখাতেই ওনার কোনো সাড়াশব্দ নেই, তখন বুঝলাম, ও আচ্ছা, আমায় শুধু ওই জ্ঞানটুকু দেওয়ার জন্যেই কপট বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো। অর্থাৎ সত্যের উপরে দল অবস্থিত। এটাই ভয়ংকর। এটাই delusion. এটাই ভিতরে ভিতরে মারে। বাইরে মারার সুযোগ করে দেয়। এটাই নিজের বিশ্বাসের ব্যবহার হতে দেওয়া। তবু বলব না - আত্মোদীপো ভব। যে বলেছিল আন ব্যাটাকে পূজো করে বলি দিই। জয় মা!