দীর্ঘদিন শিক্ষকতার জন্য কিনা জানি না, আমি দেখেছি আমি অকারণ কারোর মেজাজ নিতে পারি না। সে যেই হোক, যিনিই হোন। এই স্বভাবটা যত বয়েস বাড়ছে বেড়েই চলেছে। চিরটাকালই একা থাকতে বেশি পছন্দ করি। সাথে বন্ধুবান্ধবও পছন্দ করি। কিন্তু একটা গণ্ডী অবধি। তারপর নিজের সাথে নিজের যে সম্পর্ক, সেখানে কাউকেই পছন্দ করি না। অনেকে নিষ্ঠুর মনে করে, রূঢ় মনে করে, ‘ডিসগাস্টিংলি কুল’ বলে থাকত আমার এক বন্ধু আমায় ছোটোবেলায়।
একটা নিরিবিলি আমাদের সবার জন্য খুব দরকার। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, নির্জনবাস। সেই নির্জনবাসের জন্য আবাস ত্যাগ করার মানে হয় না, নিজের ভিতরেই নিজের জন্য একটু নির্জনতা খুঁজে না নিলে আমি দেখেছি আমি অন্তত থাকতে পারি না। সেখানে কিছু যে আমায় করতেই হবে তার কোনো মানে নেই, সব কিছু থেকে কিছুক্ষণের জন্য সরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সেখানে থাকতে হবে কিছুক্ষণের জন্য, এইতেই আমার মস্ত বড় একটা সুখ। তার কারণ হয় তো আমার স্বভাব।
নির্জনবাস ঈশ্বর চিন্তার জন্য রামকৃষ্ণদেব বলতেন। সে কথা তাঁকে মানাতো। রামকৃষ্ণের ঈশ্বর আর আমাদের ঈশ্বরের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য। দু’জনে দু’পাড়ার। আমাদের ঈশ্বর চাঁদা চায়, পুজো চায়, সিংহাসন চায়, তোয়াজ চায়, রথ চায়, মন্দির চায়, ষোড়োশ উপাচার চায়, রক্ত চায়, দল চায়, নিয়ম চায় – চায় না শুধু হৃদয় আর অন্তর্যামীত্ব। আমাদের ঈশ্বর অভিশাপ দেয়, প্রতিশোধ নেয়, লোভ করে, বায়না করে, হিসাব রাখে, বাঁশ দেয়, দেয় না শুধু চৈতন্য। সুতরাং আমাদের ঈশ্বরের সাথে রামকৃষ্ণ তথা যে কোনো মরমীয়ার ঈশ্বরের পার্থক্য অনেক। সেখানে নির্জনবাসের দরকার আছে। আমাদের হাতে স্যানিটাইজার আর মুখে মাস্ক বেঁধেও মন্দিরে যাওয়ার দরকার আছে। আসলে ওই পাথরের সাজানো মূর্তি, ধুপ-ধুনো-ফুলের গন্ধ, মন্ত্র, আরতি, ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘন্টা – এই সব মিলে একটা রেডিমেড ধর্মের বোধ জাগিয়ে তোলে। সেটা নিত্য সংসারের মধ্যে নিজের মধ্যে মেলে কি করে? সে অভ্যাসই যে গড়ে ওঠেনি। শুনেছি শুধু, বিশ্বাস হয়নি তো যে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে একটা ঘর আছে। সেই ঘরের মধ্যে আরেকটা ঘর আছে। তার মধ্যে আরেকটা ঘর। এইভাবে ঘরের পর ঘর পেরিয়ে যেতে যেতে নেশা লাগে। নিজের মধ্যে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার পথ পাওয়া যায়। ঈশ্বর সেখানে থাকুন চাই না থাকুন, নিজের কেজো-কেঠো আমি থেকে একটা মুক্তি মেলে। যে রাস্তার কথা ফকির অমলকে বলেছিল না? সেই ক্রৌঞ্চদ্বীপের কথা। যেখানে গেলে সব হালকা হয়ে যায়। যে দ্বীপে যাওয়ার পথ ভিতরের দিকে?
রবীন্দ্রনাথ বলতেন, শান্তিনিকেতন। তোমার অন্তরকে বাইরে থেকে রক্ষা করো। এত গেলো উপদেশ। কিন্তু সেটি কি করে করতে হয় তার উদাহরণ দেখতে গেলে নয় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা প্রশান্তকুমার পালের শরণাপন্ন হতে হয় – দুই রবীন্দ্রজীবনী – সম্পূর্ণ আর অসম্পূর্ণ। সেই কথা আলোচনা করতে ইচ্ছা করে না। অনেকবার মনে হয়েছে উনি যে সব অপমানের ভিতর দিয়ে গিয়ে শান্ত থেকেছেন লিখি তা নিয়ে। কিন্তু হাত সরেনি। শিক্ষালয়ে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি যে এখনও, তাই শিক্ষালয় নিয়ে লেখার ধৃষ্টতা আমি করতে পারিনে। তার বলা কথাগুলো আউড়ে যাই, যাতে আবার করে নিজেকেও শোনানো যায়, কিন্তু সে কৃতকৃত্য জীবনের দিকে তাকালে যে আমি নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে যাওয়া, ডুবে যাই যে, কে লিখবে?
কিন্তু আমার সেই নির্জনতায় ভাবের চারা রোপণ করি তো এদের নার্সারি থেকে চারা নিয়ে গিয়েই। সব গাছ বাড়ে না। অনেক গাছই মরে যায়। সেও তো আছে না? “কত প্রদীপ এই থালাতে সাজিয়েছিলে আপন হাতে/ কত যে তার নিভল হাওয়ায় পৌঁছল না চরণছায়ে”। সেই নির্জনতায় ভাবের কুসুম ফুটুক চাই না ফুটুক, সেই নির্জনতায় মাটি রুক্ষ হোক, বাতাস উষ্ণ হোক – তবু সে আমার। সেইটুকু ঘর কাউকে ছেড়ে দিলে সংসারে ভিখারির মত বাঁচতে হয়। এর ওর দরজায় ভালোবাসা, সুখ, মান ভিক্ষা করে করে বেড়াতে হয়। ভিক্ষায় কারোর দরকার হয় তো মেটে, কিন্তু আনন্দ আর তৃপ্তি মেলে কই?
পরুষবাক্য, অপমান, মেজাজ – সহ্য করি না। তার অর্থ এই নয় যে কোমর বেঁধে মাঠে নামি। ও বোকামি। সময় নষ্ট। মানুষের এক অসামান্য ক্ষমতা আছে উপেক্ষা করার। সময় লাগে, কিন্তু এই একমাত্র ঔষধ। একবার ফোঁস করে, বিষ না ঢেলে, ত্যাগ। ত্যাগ মনে হওয়াই ভালো। এও রামকৃষ্ণদেবেরই কথা। এও ভালো কথা। গীতবিতানেরও কথা –
‘যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক/ তারা তো পারে না জানিতে/ সকলের চেয়ে তুমি কাছে আছ আমার হৃদয়খানিতে।“
ডুব দিলে আনন্দ। ডুব দিলে আলো। ডুব দিলে শান্তি। ডুব দিলে ছুটি।