ওদের দেশে এই নিয়েও গবেষণা হয়! ধ্যান করে কি হচ্ছে এই নিয়ে কোন গবেষণা মানে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা, অবজেক্টিভলি ভারতে হয়েছে কি না জানি না। এই যে এত দীক্ষা, এত নানা ধরণের যোগ-কৌশল --- এতে কি আদৌ কোন স্থায়ী মানসিক পরিবর্তন ঘটে? ধরুন, এমন কোন নিয়ম হল, কোন একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তিন হাজার জন দীক্ষিত মানুষকে নিয়ে একটা সমীক্ষা করা হল। বারো বছর পর তাদের চেতনা, বিকাশ এবং অদীক্ষিত মানুষদের চেতনার বিকাশের মধ্যে কি কি পার্থক্য এল? বারো বছর ধরে লাগাতার কোন কিছু করলে অবশ্যই একটা অভ্যাসের বিবশতা তৈরী হয় বটে, তবে সেই বিবশতাকে বাদ দিয়ে সত্যিই কি চিত্তের ঔদার্য, বিচারক্ষমতা, মানবিক উৎকর্ষতা ইত্যাদি বাড়ে? যদি বলি ধর্ম ও অধ্যাত্মিকতা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মনসংযম শিক্ষার কথা, তবে সে শিক্ষার মুল্য স্বীকার করা যায়। পৃথিবীতে নানা পেশা অনুযায়ী মনোনিবেশের নানা মান গুরুত্ব পায়। কিন্তু ধর্মীয় ও অধ্যাত্মিক অনুশীলনগুলো?
মুশকিল হল, ধর্মপ্রমাণস্বরূপ মহাপুরুষেরা অন্যের ভালোর জন্য নরকে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু তার শিষ্যেরা স্বর্গ কিম্বা ততোধিক উচ্চধাম ব্যতীত অন্য কোন ধামে যেতে প্রস্তুত নয়। যীশুখ্রীষ্ট বারবণিতাদের মধ্যে চলে যাচ্ছেন; কবীর, দাদু অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌছে যাচ্ছেন; বিবেকানন্দ অন্যের ভালোর জন্য নরকে যেতে প্রস্তুত না থাকলে তাকে রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব দিতেই নারাজ, কোনোরকম রামকৃষ্ণলোকের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না, কিন্তু পরবর্তীকালে স্বর্গ ও নানা লোকে গমনের উদ্দেশ্যই প্রধান হয়ে গেল। তবু এ-ও বাহ্য।
একটা সময় নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ও নানা সম্প্রদায়ে, পাঠচক্রে গিয়ে মানুষের চড়া আমিত্ববোধ দেখে বিস্মিত হয়েছি, যে আমিত্ববোধ ছদ্ম বিনয়ের মোড়কে ঢাকা। যেন তিতো ক্যাপসুলে চকলেটের মোড়ক। কার গুরু অবতারের মধ্যে বরিষ্ঠ, কার ভগবান একমাত্র ভগবান, কার সম্প্রদায় শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায় --- এই নিয়ে বিতর্ক চলছেই। আরোও আছে, যেমন ধরুন, যে সম্প্রদায় নিরামিষ খায় তারা আমিষ যারা খায় হয় তাদের ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট অথবা কনসিডারেবল নিকৃষ্ট --- এই দু’ভাবে দেখে। নিজের সমপর্যায় ভাবার ক্ষমতা তাদের নেই। নিরামিষ খাওয়ার গর্ব কি সাংঘাতিক! প্রচ্ছন্নভাবে এই অহংকার দ্বারা তাদের ব্যক্তিত্ব যে নিয়ন্ত্রিত তা তারা নিজেরাও বোধ করি টের পায় না। তেমনই যে একঘন্টা জপ করে, কিম্বা উপোষ করে, কিম্বা ধ্যান করে, অথবা তীর্থে যায় --- এদের বহু মানুষের মধ্যে এই চড়া আমিত্ব’র প্রচ্ছন্ন অবস্থান অনুভব করা যায়। কিছু বললেই তাদের ভাবাবেগে আঘাত লাগে, হাত-পায়ের নখ বেরিয়ে যায়।
কথামৃতের একটা ঘটনা আছে, একবার আদি ব্রাহ্মসমাজ ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে তর্ক চলছে। তর্কের বিষয় --- নানা অসঙ্গতি। রামকৃষ্ণদেব শুনছেন। কেউ একজন আপত্তি তুলে বললেন, এসব আলোচনা আবার কেন? রামকৃষ্ণদেব বলেন, না না। এসব আলোচনার দরকার আছে। কারণ অন্যায় ও অসত্য দেখলে চুপ করে থাকতে নেই।
এবারে বর্তমানে আসুন। যখন সেই মানুষটির নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানের নানা অসঙ্গতি নিয়ে লিখতে গেছি, তখন নানা আক্রমণের মুখোমুখি পড়তে হয়েছে। বন্ধুবিচ্ছেদ হয়েছে, কুকথা শুনতে হয়েছে। কারণ, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তাদের ইগো জড়িয়ে। কি আয়রনি! এদিকে রোজ ‘খন্ডন ভব’ গাওয়া হচ্ছে, ওদিকে সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার নিরহংবোধও জন্মাচ্ছে না।
একজন চিকিৎসক, একজন লেখক, গায়ক, অভিনেতা, উকিল, শিক্ষক ইত্যাদি ইত্যাদির যে কেউ অহংকারি হতে পারে। না হলে ভাল, কিন্তু হওয়াটা অসঙ্গত কিছু নয়। কিন্তু একজন যিনি নিজেকে আত্মবোধ জাগরণের সাধক বলেন, মানে অধ্যাত্মিক পথের পথিক বলেন, তার অহমিকা থাকা সোনার পাথরবাটি তুল্য। যে ‘আমি’রূপ ঢিপি নিচু না হলে রামকৃষ্ণের ভাষায় ‘কৃপারূপ জল দাঁড়ায় না’, সে ‘আমি’রূপ ঢিপিকে নানা অলঙ্কারে সুসজ্জিত করে রাখলে তা তার শোভা না বাড়িয়ে, গৌরব না বাড়িয়ে তাকে লজ্জাই দেয়। কারন, সে পথের প্রথম শর্তই হল স্থূল আমিত্ববোধের ত্যাগ। সে শেষের কথা নয়, সে-ই শুরুর কথা।
একবার ভাবুন, সত্যিই যদি এমন সমীক্ষা হয়, সত্যিই যদি দেখা যায় বারো বছরের গবেষণার পরে কোন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই আর অহমিকার বিষটা নেই, তবে তা কত ভালই না হয়? কিন্তু বাস্তবটা আমরা জানি। সেই সমীক্ষা অনুসারে যদি সেই ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোর কপট গুরুগিরির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, এবং বলা হয় তোমাদের প্রদর্শিত পথে শুধুমাত্র মোটা মোটা অহংকারযুক্ত মানুষই তৈরী হয়ে যাচ্ছে, বিবেকী নিরহংকারী মানুষ তৈরী হচ্ছে না, এতএব তোমরা ব্যর্থ, তাই তোমাদের সে অধিকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, তখন? তারা বলবে, আমরা সবাই ভাল, পথও ভাল, শিষ্য ভাল না। তখন তাদের বলা হবে, ভাল শিষ্য খারাপ শিষ্য বোঝার ক্ষমতা যদি তোমাদের না থাকে, সে-ও কি তোমাদের লজ্জা নয়?
এর বিপরীতে এমন অনেক তথাকথিত অধ্যাত্মিক জীবনহীন নম্র ভদ্র মানুষ আমরা দেখি। তাদের কোন গুরু নেই, প্রতিষ্ঠান নেই, কিন্তু তাদের একটা সাধারণ বুদ্ধি আছে। সাধারণ বুদ্ধি যদি কোন মানুষের বিকৃত না হয়ে থাকে তবে তার আলাদা করে নানা কৌশলে আমিত্ব হননের রাস্তা বাছতে হয় কি? আমার বিশ্বাস হয় না। নানা কৌশল ইত্যাদি কোন মহাপুরুষই শেখান নি। কেউ বলেছেন, নাম কর; কেউ বলেছেন, প্রার্থনা কর; কেউ বলেছেন, সেবা কর --- কিন্তু সে সবই ভালবেসে কর। বাকি যা কিছু পড়ে থাকে সে ব্যবসা, সে কৌশল। ‘সত্য বল, সুপথে চল’ লালন গোঁসাইয়ের একথা, সাধারণ বুদ্ধিকে ডাক। মানুষের সাধারণ বুদ্ধি মানুষের শ্রেষ্ঠতম আশীর্বাদ। বাদবাকি সব অলংকরণ, আভরণ। সাধারণ বুদ্ধিটাকে মেরে শুধু ঐসব কৌশল নিয়ে পড়ে থাকা সজ্জিত মৃতদেহ বৈ আর কিছু নয়। প্রাণ নাই শুধু কথা, আর কথা, আর কথা আছে...