Skip to main content
 
 
সেদিন বেসিনে মুখ ধুচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম বেসিনের সাদা রঙের উপর আরেকটা উজ্জ্বল সাদা আলো। বুঝলাম বেসিনের উপর যে ছোট্ট জানলা সেই দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। এ যেন হঠাৎ করে বাড়তি একটা পাওয়া। মন চমৎকৃত হল। খুব দূরের অধরা কিছু আজ যে তার নাগালের মধ্যে, সে যে কি পুলকিত হল, তা বলার নয়।
        নাগালের মধ্যে। এই কথাটা খুব একটা বড় কথা। সংসারে আর যেখানে যত মণিমাণিক্যই ছড়িয়ে থাক, সে যদি আমার নাগালের মধ্যে না এলো তবে যে সবই বৃথা। আমার তাতে কোনো সুখ নেই, কোনো তৃপ্তি নেই। তার উপর যদি অন্যের নাগালের মধ্যে সে সুখকে দেখলাম তো বুকের ভিতর এক লক্ষ বাদুড়ের ঝটপটানি। ওরা ঈর্ষা, ওরা আমারই বুকের রক্ত চুষে আমাকেই ক্ষীণ দুর্বল করছে। তবু ওরা আছে। কারণ দুটো। এক, ওরা বড্ড obvious, নীতিমালার মত রামধনু নয়; আর দুই, ওরা আমার নাগালের মধ্যে।
        "কেবল তুমিই কি গো এমনি ভাবে রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে?... তুমি সাধ করে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিয়ো---' 
        কি গাইলাম? নাগালের মধ্যে পাওয়ার গান। নাগালের মধ্যে ডাকার কথা। তুমি যদি নাগালের মধ্যে আসো, তবে, 'আমার হৃৎকমলের রাঙা রেণু রাঙাবে ওই উত্তরীয়'।
এসো সুখ, আমার নাগালের মধ্যে বসো। এসো নাম-যশ-খ্যাতি-সম্পদ, আমার নাগালের মধ্যে বসো। দেবী ইহ তিষ্ঠ, ইহ তিষ্ঠ, ইহ তিষ্ঠ। তুমি আমায় ভোগ করো, আমিও করি তোমায় ভোগ। তুমি অন্যের হয়ো না দেবী, বড়ো বাজে গো বুকে। তুমি অধরা থেকো না দেবী, আমার মানবজনমের সব আয়োজন হবে ব্যর্থ। রহো রহো দেবী রহো।
        তবু হাত ছাড়িয়ে চলে গেল কত। হাতের মধ্যে যা এলো না সে তো অসীম। মন জানে সে হিসাবে সে থই পাবে না। এক আঁজলা জল নিয়ে সারা সমুদ্রটাকে যে আহবান জানানো যায় না, সে কথা সে কি আর জানে না? খুব জানে। তবু তার নাগালের মধ্যে চাই সব।
        মন সে অসীমকে বলল, তুমি ঈশ্বর। বলল, তুমি তো সব পারো, এনে দিতে পারো না এই সারা সমুদ্রটাকে আমার হাতের মুঠোয় ভরে? তুমি যে কৃপাসিন্ধু!
        ঈশ্বর বললেন, পারি তো। তুমি হাতের মুঠোটা বড় করো দেখি আরেকটু? ভক্ত বলল, আরো একটু? এই এতটা? বলে সে হাতের মুঠো খানিক বড় করল। ঈশ্বর বললেন, হল বটে, তবে আরো খানিক বড়ো করো, তুমি পারবে। ভক্ত আরো খানিকটা বড়ো করে বলল, হল এবার? ঈশ্বর একই কথা বললেন আবার, হল তো, তবে আরো খানিকটা, এই বলে তিনি সাগরের বুক থেকে আরেক আঁজলা জল দিলেন ভক্তের হাতে। ভক্তের আনন্দঘটে লাগল অমৃতের স্বাদ। সে আরো বড় করতে চেষ্টা করল তার মুঠি। তার কষ্ট হল, কান্না পেলো, তবু সে চেষ্টাটা থামালো না। একদিন দেখল তার মুঠোর বাঁধন আলগা হয়ে পড়ছে, তাতে আকাশ এসে বসল। তার মুঠোর রঙ হল নীল। ভক্ত কাঁদল। যন্ত্রনায় না, আনন্দে। সে মুঠো ক্রমে জল হল, মাটি হল, বাতাস হল। তারপর এক অলীক আলোয় মিলিয়ে গেল। সে কেঁদে বলল, ঈশ্বর তুমি কই? ঈশ্বর বলল, আদিতে যা ছিলাম, অসীম, তাই আছি তো গো। যাকে তুমি নাম দিয়েছিলে ঈশ্বর। আজ তুমিই তাই - অসীম।
        ভক্ত বলল, আমি বুঝছি না যে? অসীম বলল, অসীম হয়ে অসীমকে বুঝবে কি করে? ভক্ত বলল, তবে আমার আনন্দের কি হবে? আমার নাগালের কি হবে? অসীম বলল, আমায় দাও। তোমার সসীম নাগালকে আমাতে দেবে বলেই না এত আয়োজন! ভক্ত বলল, আমায় পেয়ে তোমার লাভ? অসীম বলল, আমায় না পেলে তোমার যে ক্ষতি, তার থেকে তোমায় বাঁচানোতেই আমার লাভ, আমার আনন্দ। আলোর আনন্দ অন্ধকারের উপর জোর খাটিয়ে না, অন্ধকারকে আলিঙ্গন করে। অন্ধকার তাতে আলো হয়ে ওঠে, তাতেই আলোর সার্থকতা।
        আজ সেই দিন। তুমি তোমার নাগাল নিয়ে আমার সামনে দাঁড়াও, আমাকেই চাও, আমার থেকে কিছু চেয়ো না। বলো - সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম। সত্য জ্ঞান অনন্তই শাশ্বত। তুমি তাই। হয়ে দেখো।
 
 
        গল্পটা আমাদের এখানেই শেষ হলে পারত। হল না। কারন এ গল্প অসম্পূর্ণ। অর্ধসত্য। অসীমকেও যে সসীমের দরজায় দাঁড়াতে হয়েছে সময়ে সময়ে।
        "তুমি সাধ করে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিও"
        দেবী সরস্বতী কি কোনোদিন রাধা হতে চেয়েছেন? তবু হয়েছিলেন। নবদ্বীপে। সরস্বতী নেমেছিলেন রাধাকুণ্ডে। আর ওঠেননি। ভারত মাধুর্যে ভেসেছিল। জ্ঞান মধুর হয়ে ছিল। ভীষণ হয়নি।