সৌরভ ভট্টাচার্য
12 March 2018
অসীমের কি সহানুভূতি আছে? অসীম একটা অস্তিত্ব, নাকি মানবিক চেতনার একটা আভাস। রামকৃষ্ণ বলছেন, “মানুষ কি কম গা? মানুষ অনন্তকে চিন্তা করতে পারে।“ অনন্ত মানে কি মহাকাশ? অসীম কি মানবিক চেতনার অবসর? রবীন্দ্রনাথ নিজের ছোটোবেলায় গায়ত্রী মন্ত্রের অনুভূতি বলতে গিয়ে বলেছেন, সে মন্ত্র তাকে অসীমের মধ্যে বিচরণের জন্য যেন অবসর দিত। দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্রতা, সীমা ছাড়িয়ে তিনি অসীমের মধ্যে নিজের চিত্তকে উন্মুক্ত করতেন, তার চোখের কোল জলে ভরে উঠত।
এর অর্থ কি তবে? তবে কি সত্যিই অসীম অনুকম্পাশীল? পৃথিবীর ইতিহাস দেখলে তো তা মনে হয় না। সেখানে এত হানাহানি, এত রক্তপাত, এত নিদারুণ অসহায়তা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা – এসব কি অনুকম্পার নিদর্শন? তা তো নয়। তবে? তবে কি শূন্যতার পাশে হতাশা – এই আমাদের ভবিতব্য?
মরমী সাধকের জীবন বলে, না, তুমি অসীমের অনুকম্পায় আস্থা রাখো। আমি জানি পৃথিবীতে বহু অন্যায়, বহু অবিচার, বহু নিষ্ঠুরতা – তবু বলি আস্থা রাখো। অসীমের মানবিক অস্তিত্বে ভরসা হারিও না। অন্যদিকে বিজ্ঞানী বলে, এ সংসার অণু-পরমাণু'র সংঘাতে সৃষ্ট পরিকল্পনাহীন ঘটনাপ্রবাহ। এর মধ্যে কার্য-কারণ সূত্র আছে, কিন্তু তার মধ্যে কোনো অন্তর্নিহিত অর্থ নেই। তোমার বানানো অর্থের দায় তোমাকেই বহন করতে হবে। অসীমকে তুমি যতই মানবিক ব্যক্তিরূপে দেখতে অভিনিবিষ্ট হও না কেন, অবশেষে সব শূন্য।
তবে কি সত্যিই এ জগত অনুকম্পাহীন, পরিকল্পনাহীন এক ঘটনাপ্রবাহের মালা? কার কাছে প্রশ্ন করছি? প্রশ্ন করছি আমার অন্তঃকরণের কাছে। আমার অন্তঃকরণ কি? আমার আবেগ, বুদ্ধি, স্মৃতি। আমার এই ত্রয়ীর কাছে আমার এ প্রশ্ন খুব বড় জটিল প্রশ্ন হয়ে গেল নাকি? তবে? আমার মধ্যে আরেক সত্তা আছে – স্বজ্ঞা – Intuition। সে কি অব্যর্থ? কে উত্তর দেবে? আমার মধ্যের স্থিত ত্রয়ী? তারা কি সত্যিই স্থিত? তাও নয়ত। এরা তো নিত্য পরিবর্তনশীল। সেই পরিবর্তনের আভাসও কি আমার চেতনায় আছে?
এখানে একটা কথা আছে। কথা থেকে তত্ত্ব বলাই ভালো। তবে তত্ত্ব মানে ইংরাজিতে যাকে 'থিওরী' বলে তা নয়। তত্ত্ব মানে মূল সত্য। যেমন একটা পাখা ঘুরছে তার মূল সত্য বিদ্যুতের নির্দিষ্ট প্রবাহের ব্যবহার প্রণালী -- সেই হল তত্ত্ব। তো এই ক্ষেত্রে একটা তত্ত্ব আছে যা আমাদের বৈদান্তিক দার্শনিকেরা দিয়ে থাকেন, সে হল তোমার এই ত্রয়ীর পরিবর্তনশীলতার পিছনে কে ধ্রুব আছে, যে সেই পরিবর্তনগুলোকে উপলব্ধি করতে পারছে? --- এই হল আত্মতত্ত্বের ভিত্তিভূমি। অর্থাৎ, আমার এই ত্রয়ীর পিছনে 'আত্মা' নামক অপরিবর্তনীয় চেতন সত্তা আছে, যে আমার সব পরিবর্তনের দ্রষ্টা। এই 'দ্রষ্টা' শব্দটা বেদান্ত দর্শনে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। অনেকে এই তত্ত্বের উদাহরণ দিতে গিয়ে সিনেমার পর্দা'র উল্লেখ করেন, যেমন সাদা পর্দায় নানা ছবি প্রতিফলিত হয়ে ওঠে কিন্তু অবশেষে সেই পর্দা অবিকৃত থাকে ইত্যাদি। তবে কি তাই? মনোবিজ্ঞান কি বলে? আচ্ছা মনোবিজ্ঞানে পরে আসব। আগে শুনি বেদান্ত দর্শনের ঘোরতর বিরোধী বুদ্ধ কি বলেন। বুদ্ধ বলেন, এই ত্রয়ী একটা দীপশিখার ন্যায় কিম্বা একটা স্রোতস্বিনী নদীর ন্যায়। অর্থাৎ যেমন দীপশিখার প্রতি মুহূর্তের শিখাটা প্রতিক্ষণের জ্বলনে উৎপন্ন একটা ধারাবাহিক ঘটনা, অথচ যেন একটাই স্থির শিখারূপে ভ্রান্তভাবে প্রতীয়মান, এও তাই। আবার যেমন নদীর প্রতিক্ষণের জলধারা নতুন, অথচ দেখে মনে হয় একই নদী – এও সেরকম। অর্থাৎ কিনা আমাদের এই ত্রয়ী সত্তা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল একটা তত্ত্ব। এর কি কোনো দ্রষ্টা আছে? বুদ্ধ বলেন, নেই। তবে আমি কে? বুদ্ধ বলেন, তুমি নিয়ত পরিবর্তনশীল একটা সত্তা। তুমি স্থির নও। তুমি নিজেকে যে স্থির ভাবো এও এক ভ্রান্তি। এই হল মোটামুটি বুদ্ধের 'অনাত্মবাদ তত্ত্ব'।
তবে কি দাঁড়ালো? আপাতত ঘেঁটে গেল। তবে পরিবর্তনটাই ধ্রুব। এবার আসা যাক আমাদের মনোবিদেরা কি বলেন। সে কথায় আসার আগে বলি, আমি যা বলছি আমার স্বল্পজ্ঞান থেকে বলছি। এর বাইরে যাদের আরো জ্ঞানের গভীরতা তারা আরো বিশদে বলবেন নিশ্চই। তবু যেটুকু পুঁজি তাই থেকেই বলি। আমাদের মনের দুটো স্তর আছে। একটা 'চেতন' আরেকটা 'অচেতন'। ‘অবচেতন’ স্তর নিয়ে নানা মত আছে। অনেকে মানেন, অনেকে মানেন না। আমি না মানার দলেই রইলাম আপাতত। তবে কথা হচ্ছে আমাদের মনের গভীরে আরেকটা স্তর আছে। সেই সব কিছুকে দেখছে, স্মৃতিতে রাখছে, ভিতর থেকে কলকাঠি নাড়ছে, আমার চরিত্র গঠন করছে। আমার চরিত্র বলতে আমি যে কোনো ধরণের চরিত্রই বলতে চাইছি। তবে কি সেই-ই দ্রষ্টা? কোনো কোনো বৈদান্তিকের মতে আমাদের তিনটে স্তর আছে। জাগরণ, সুপ্তি আর সুষুপ্তি। বলা হচ্ছে আমাদের গভীর ঘুমের মধ্যে যে অবস্থায় আমাদের চেতনার একটা ক্ষীণ ধারা জাগ্রত থাকে, সেই-ই আত্মা। যার ফলে আমরা আবার আমাদের জাগ্রত অবস্থায় আমাদের পূর্ণ চেতন স্তরকে ফিরে পাই।
তবে কি সেই গভীরতম মনের স্তরকেই আমাদের বৈদান্তিক দার্শনিকেরা আত্মা বলে ধারণা করেছিলেন। এর উত্তর স্পষ্ট দেওয়ার মত কেউ নেই। তবে বুদ্ধের কথা শুনে খানিক তাই ধারণা হয় বটে। কিন্তু বুদ্ধ কেন বললেন, আমাদের এই পরিবর্তনের ক্রমময়তা আমাদের দেহনাশের পরও অব্যহত থাকে এবং আরেকটা দেহ ধারণ করে সেই পরিবর্তনের ধারা চলতেই থাকে যতক্ষণ না আমরা বাসনামুক্ত হই। অর্থাৎ সবরকম তৃষ্ণামুক্ত হই। সে কি তবে আরেকভাবে আত্মতত্ত্বের আভাস? যে আত্মতত্ত্ব সেমি-অমরত্বের অধিকারী? থাক, এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে সক্ষম নয়। কেন নয়?
আমাদের আহরিত জ্ঞান দুই প্রকার। এক, প্রামাণ্য; দুই, শুধু আত্মগত। একটা স্থূল উদাহরণ দেওয়া যাক। আমার প্রচণ্ড দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় চেপেছে, সে জ্ঞান আমার মনের মধ্যে যদিও আছে, কিন্তু তা কি আর প্রমাণ করা সম্ভব? কিন্তু আমার ফোঁড়া পেকে পুঁজ জমেছে, কিম্বা আমার চোখের নার্ভ শুকিয়ে আসছে, এ প্রমাণ করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে উপায় কি? এক্ষেত্রে উপায় হয় রাশিতত্ত্ব'র সাহায্য নেওয়া, অথবা কোনো একটা প্রকল্পিত তত্ত্বকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা। রাশিতত্ত্ব অনুযায়ী সব সাধকদের অনুভূতি নিয়ে যদি একটা পরিসংখ্যান করা যায় তাদের মধ্যে মিল ও অমিল কতটা, তবে এক তত্ত্বের আভাস মেলে। সেই অর্থে একটা কথা বলা যায়, এরা প্রত্যেকেই ক্ষমাপরায়ণতা, করুণা, সত্যপরায়ণতা আর সহনশীলতার কথা বলেছেন। নিজেদের মধ্যে মূল তত্ত্বের পার্থক্য থাকলেও। তবে এই উপলব্ধির উৎস কি তাঁদের?
এর উত্তরও আমাদের অজানা। তবে একটা বিপরীত তত্ত্ব আমরা এর থেকে টানতে পারি। যারা এই কয়েকটা মূল সত্যের কাছাকাছি আসতে পারেননি তারা সত্যপ্রতিষ্ঠ নন। এ সিদ্ধান্তে আসার কারণ কি? শুধুই কি এগুলো নীতি হিসাবে খুব সার্বজনীন বলে? একদম তাই। বিজ্ঞান আমাদের একটা বড় সত্যে মুক্তি দিয়েছে – সার্বজনীনতা। বিজ্ঞানের কোনো সত্য দেশ-কাল-পাত্র বিশেষে সীমাবদ্ধ নয়। ফলিত নানাভাবে হলেও। মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব পাত্র-পরিবেশ বিশেষে পৃথক প্রাবল্যে হলেও আদতে তত্ত্বগতভাবে তা ধ্রুব। এই সার্বজনীনতাই ধ্রুব। পাই-এর মান যেমন ধ্রুব। শূন্য যেমন ধ্রুব। এই ধ্রুব সত্যের আভ্যন্তরীণ রূপ – ক্ষমা-সত্য-করুণা-সহনশীলতা।
যে প্রশ্নে শুরু করেছিলাম, তবে কি অসীম অনুকম্পাশীল? জগতে নানা ধ্বংসলীলার দিকে তাকালে মনে হয়, না। কিন্তু এত সহস্র সহস্র যুগের এত ধ্বংসলীলার পরেও যখন এত জীবের ধারক-পোষক প্রকৃতির দিকে তাকাই, মনে হয় হ্যাঁ-ও বটে।
আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের মৃত্যুর পরওয়ানা হাতে করে ঘুরতে ঘুরতে এ হিসাবে মন টেকানো শক্ত যদিও। ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ, অভাব, অবিচার, ক্ষোভ ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনই ব্যক্তিগত জীবনের লাভ-সুখ-আনন্দ-তৃপ্তিও তো আছে। কোনো একটাকে বড় করে দেখলে কোথাও একটা সামঞ্জস্যতা নষ্ট হয়, আর সেই নষ্ট সামঞ্জস্যতাকেই যদি একমাত্র সত্যি বলে ধরে নিই তবে জীবনের অনেকগুলো মুহূর্তের অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করা হবে।
আমাদের সেই হৃত সামঞ্জস্যতাকে ফিরে পেতে হবে। ব্যক্তি জীবনে আর সমষ্টিগত জীবনে। কাউকে অনুসরণ করে সে পথে যাওয়া মুর্খামি। কাউকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করাকে যদি অনুসরণ বলো আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কাউকে ধ্রুব বানিয়ে সামঞ্জস্যতা না ব্যক্তিজীবনে আসে, না সমষ্টিজীবনে। গভীর পর্যবেক্ষণ, অনুধ্যান, আত্ম-সমালোচনাই সে পথে হাঁটার নিশ্চিততম উপায়। তাতে ভুল হবে না তা তো নয়। কিন্তু সে ভুলের একটা ব্যাখ্যাও থাকবে, যার উপরে পরের ঠিকটা দাঁড়াবে। কিন্তু অন্ধ অনুসরণে ভুলের কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধু আনুগত্যের পরিমাপ আছে। তাতে সমূলে বিনষ্টি।