সান্ত্বনা, না শান্তি?
প্রতি পদে পদে যদি সান্ত্বনা চাই, শান্তি পাই কি? ক্ষতি, আঘাত, শোকতাপ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সান্ত্বনা নয়।
মন্দিরের প্রবেশদ্বারের বাইরে রাস্তার দুপাশে পুজোর ডালা সাজানো থাকে। বিক্রির জন্য। সে ডালায় ফুল, মালা, ফল সব থাকে। প্লাস্টিকে মোড়া। টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে ঢুকলেই হয়। সেই ডালার ফুল আমার তোলা নয়, মালা আমার গাঁথা নয়। আমার যে পরিমাণ টাকা আছে, আমার ডালা সেই অনুপাতে নানা উপাদানে ভরে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। সান্ত্বনার জন্যেও আমরা মাঝে মাঝে ওরকম রেডিমেড ডালা খুঁজি। নিজেকে ঠকাই। ঠকানোর ব্যবসা খুলতে সাহায্যও করি।
সান্ত্বনা ওভাবে রেডিমেড পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষতি, অনেক শোকের সান্ত্বনা নেই। এ সত্য। নির্মম সত্য। সময় ধীরে ধীরে প্রলেপ লাগিয়ে যায়। ক্ষত সবটা না সারলেও মোটামুটি চলনসই হয়ে যায়। কিন্তু নকল সান্ত্বনায় না পাওয়া যায় শান্তি, না থাকে দুঃখের, শোকের মর্যাদা। নিজেকে প্রতারণা করে কে কবে এগোবার রাস্তা পেয়েছে? সে তো একটা ঘূর্ণি।
দুর্বল মন নকল সান্ত্বনায় নিজের একটা প্রসাধনী কক্ষ খোঁজে। সেখানে সে শোক নিয়ে বিলাস চায়, ক্ষতিপূরণ চায়। শোক, দুঃখকে উপজীব্য করে আরো বড় আঘাত থেকে বাঁচার ফিকির খোঁজে। সে বলে, দেখো আমি ইতিমধ্যে অনেক শোকে জরজর, আমায় রেহাই দাও।
রেহাই নেই। যখন সে দেখে তাও রেহাই নেই, তখন সে ক্ষোভ উগরে, রেগেমেগে সমস্ত সংসারকে এক বিশ্বাসঘাতকের আড্ডা ভাবে। এ হয়। ভাগ্যের মারে মরে যারা সান্ত্বনাদেবীর আঁচলের ছায়ায় আশ্রয় চায়, তারা ক্রমে নিজেকে আরো দুর্বল করে নিজেকে নিজেরই বিড়ম্বনা করে তোলে। মানসিক দুর্বলতা এক চোরাবালির মত।
সান্ত্বনা নয়, শান্তি নয়, শুশ্রূষা নয়, যা চাই সে হল এগিয়ে যাওয়ার জোরটুকু। সান্ত্বনা, আর শান্তির জন্য প্রার্থনা - দুটো চাওয়াই নিজেকে দুর্বল করার প্রকারান্তরে চেষ্টা। সহ্য করতে হবে। কেন সহ্য করব, এ অবোধের মত প্রশ্ন। বাচ্চারা যেমন জিজ্ঞাসা করে, কেন স্কুলে যাব? কেন পড়াশোনা করব? সেরকম।
শোক-দুঃখ, ক্ষতি সব কিছুর মধ্যে নিজের বোধবুদ্ধিটুকু যতক্ষণ টাল না খায়, টাল খেয়েও যদি আবার স্থির হয়ে যায়, তবে আর চিন্তা নেই। চোখ থাকলে আলো যেমন দেখতে পাবই আজ না হয় কাল, তেমনই শুভবুদ্ধি জেগে থাকলে আলোর রাস্তা আজ না হয় কাল দেখতে পাবই, নিস্তারের পথ পাবই। এ সান্ত্বনা, বা শান্তির চাহিদা নয়, এ আশার কথা। আশা মানে শুভচিন্তার শ্বাসপ্রশ্বাস। যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ আমিও আছি, আমি হয়ে।